

ইসমাইল মাহমুদঃ
চা বাগান, পাহাড়, জলপ্রপাত, আগর বাগান, রাবার বাগান, হাওর, বিল, লেক বেষ্টিত পর্যটন নগরী ও প্রকৃতির রাণী হিসেবে খ্যাত মৌলভীবাজার জেলা এবারের ঈদে পতিত হয়েছে পর্যটক খড়ায়। প্রতি বছর ঈদ, পূজা, নববর্ষসহ সরকারি নানা ছুটির ফাঁকে দেশ-বিদেশের নানা স্থান থেকে লক্ষ-লক্ষ পর্যটক আসতেন মৌলভীবাজার জেলার প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর স্থানগুলো দেখতে। কিন্তু এবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। গত ঈদ-উল-ফিতরে যত পর্যটক এসেছিলেন মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন স্পটগুলোতে এবার তার চার ভাগের একভাগ পর্যটকও আসেননি। ফলে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক লোকসানে পতিত হয়েছেন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ব্যবসায়ীসহ পর্যটন শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হামহাম জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, টি মিউজিয়াম, বধ্যভূমি একাত্তর, মুরইছড়া বনাঞ্চল, যজ্ঞকুন্ডধারা, কমলা রানীর দীঘি, রাজা সুবিদ নারায়নের রাজবাড়ি, লীলা নাগোর বাড়ি, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর স্মৃতিসৌধ, চা কন্যা ভাস্কর্যসহ প্রায় দুই শতাধিক পর্যটন স্পট। ২/৩ বছর আগেও এসব স্পটে সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার যে পরিমাণ পর্যটন আসতেন এবার ঈদে তার অর্ধেকও আসেননি। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন সাম্প্রতিক কালের সিলেটের ভয়াবহ বন্যা ও পর্যটকরা পদ্মা সেতুমুখি হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন শিল্পে একপ্রকার ধ্বস নেমেছে।
ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন জেলার বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা গেছে, স্পটগুলো পর্যটক শুন্যতায় অনেকটা নিরব-নিস্তব্ধ। প্রতি বছর ঈদে চা বাগানগুলোতে হাজার হাজার মানুষ একসাথে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেও এবার চা বাগানে পুরোপুরি শুন্যতা বিরাজ করছে। তবে স্থানীয় লোকজন ঈদের ছুটি কাজে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্পটগুলোতে।
ঈদের পরদিন সোমবার বধ্যভূমি একাত্তরে গিয়ে কথা হয় রাজশাহীর ব্যবসায়ী শামীম হোসেনের সাথে। তিনি স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন মৌলভীবাজার জেলায়। ঈদের আগেরদিন এসে তিনি ঘুরেছেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, চা বাগানসহ জেলার বেশ কয়েকটি স্পটে। শামীম জানান, ২০১৮ সালের ঈদেও তিনি এ জেলায় এসেছিলেন। তখন যে পরিমান মানুষের আনাগোনা দেখেছেন এবার তার দশ ভাগের একভাগও দেখেননি। তবে পর্যটক কম হওয়ায় এবার তিনি মৌলভীবাজার জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনভরে উপভোগ করেছেন বলে জানান।
ইকো ট্যুর গাইড শ্যামল দেববর্মা ও সাজু মারছিয়াং বলেন, ‘ঈদের তিনদিন (ঈদের আগের দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পরিদিন) আমরা আমাদের মৌসুম হিসেবে মনে করি। ওই সময়কালে আমরা কয়েক হাজার পর্যটককে গাইড করি। কিন্তু এবার এতো কম সংখ্যক পর্যটক এসেছেন যে, আমরা গাইডিং-এ আসার পর এতো কম পর্যটক দেখিনি।’
লেমন গার্ডেন রিসোর্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘অতিমারী করোনাকালীন সময়ে পর্যটকরা এখানে আসার জন্য ব্যকুল হতেন। আমরা পর্যটকদের ঝুঁকি নিয়ে এ জেলায় ভ্রমণে নিরোৎসাহী করি। এখন আমরা পর্যটকদের জন্য ব্যকুল হয়ে বসে আছি। কিন্তু পর্যটক নেই বললেই চলে। অতিমারী করোনার কারনে গত দুই বছর যাবত অনেক কষ্টে রয়েছি। তার উপর এবার ঈদে আশানুরূপ পর্যটন না আসায় আমরা ব্যবসায়ীকভাবে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। এ ক্ষতির ধকল কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর।’
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কো-ম্যনেজমেন্ট কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, গত ঈদ-উল-ফিতরে তিন দিনে মোট ৮ হাজার ৯শ’ ৩২ জন (৬ জন বিদেশী সহ) লাউয়াছড়া দেখতে এসেছিলেন। পর্যটকের প্রবেশ মূল্য থেকে মোট রাজস্ব আয় হয়েছিল ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার ৩শ’ ৪৫ টাকা। এবার ঈদের দিন ও ঈদের পরদিন সর্বসাকুল্যে প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক পর্যটক এ জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করেন। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন। অনেক সময় সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার এর থেকে অনেক বেশি পর্যটক আসেন লাউয়াছড়ায়।
শান্তিবাড়ি ইকো কটেজের স্বত্ত¡াধিকারী তানভীরুল আরেফিন লিংকন বলেন, ‘প্রতি বছর দুই ঈদ, দুর্গাপূজো ও নববর্ষে তাঁর ইকো কটেজের সবগুলো কক্ষ একমাস আগেই বুকিং হয়ে যায়। এবার ২/১টি কক্ষ ছাড়া বাকি সবগুলো কক্ষতেই সুনশান নিরবতা।’
মৌলভীবাজার জেলা পর্যটন সেবা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের সত্ত¡াধিকারী মো. সেলিম আহমেদ বলেন, ‘এবারের ঈদে পর্যটকদের বরণ করতে পুরো জেলায় প্রায় তিন শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, কটেজ প্রস্তুত ছিলো। অন্যান্য বছর ঈদের এক সপ্তাহ আগেই সবগুলো বুকিং সম্পন্ন হতো। কিন্তু এবার অনেকগুলো হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা এবং পদ্মাসেতু মৌলভীবাজারের পর্যটন শিল্পে প্রভাব ফেলেছে। পদ্মা সেতু উদে¦াধনের পর দেশের নানা প্রান্তের মানুষ স্বপ্নে এ সেতুটি দেখতে দলে-দলে ভিড় করছেন, অন্যদিকে ঈদের আগ মুহুর্তে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারনে মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন শিল্পে ধ্বস নেমেছে। এই ঈদে পর্যটক না আসায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সম্মিলিতভাবে কয়েক কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখিন হয়েছেন।’