
নুরুল হোসাইন, টেকনাফ:
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপরাধ প্রবণতা আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আলোচিত মাস্টার নবী হোসেন গ্রুপর মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ তীব্র রূপ নিচ্ছে। হামলার প্রতিশোধ নিতে নবী গ্রুপের সদস্যরা আরসার সমর্থক ক্যাম্পের প্রহরীদের টার্গেট করে হত্যা করছে। বুধবার রাতে গুলিতে সলিমুল্লাহ ওরফে মো. সেলিম (৩০) নামে ক্যাম্পের এক প্রহরী নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে এক সপ্তাহে ক্যাম্পের তিন প্রহরী নিহত হলেন। এছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হচ্ছে। মারামারি, খুন, অপহরণ তো আছেই।
জানা যায়, সীমান্ত ও ক্যাম্পের ভেতরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২ সপ্তাহ আগে নবী হোসেনের আস্তানায় হামলা চালায় আরসার সন্ত্রাসীরা। ওইদিন তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নবী হোসেনের ভাই ভুলুসহ ৬ জন নিহত হয় বলে গুঞ্জন রয়েছে। ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে ক্যাম্পে বড় ধরনের নাশকতা ও হামলার প্রস্ততি নিয়েছে মাস্টার নবী হোসেন গ্রুপ। টার্গেট করা হয়েছে কথিত আরসার সদস্য ও তাদের পরিবারকে। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা। এ কারণে আরসার সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবকদের হত্যা করছে নবী হোসেন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহকে হত্যার পর আরসার মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে আরসা। অনেকেই আরসার আমির আতাউল্লাহ জুননীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে আরসা ত্যাগ করে। এ সুযোগে কৌশল ও বল প্রয়োগ করে কথিত আরসার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় মাস্টার নবী হোসেন। এ কারণে কথিত আরসার আমির আতাউল্লাহর নির্দেশে নবী হোসেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি তার আস্তানায় হামলা হয়।
এদিকে দিন দিন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপরাধ প্রবণতা আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে খুন, অপমৃত্যুসহ নানা অপরাধ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব অপরাধ, একের পর এক ঘটতে থাকলেও প্রশাসনের দমন-নিপীড়ণে কোন কার্যকরী ফল পরিলক্ষিত হচ্ছে না। খুনের মামলায় আসামী গ্রেফতার, ডাকাতি ও ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা ধর-পাকড়, মালয়েশিয়া পাচারকালে রোহিঙ্গা উদ্ধার এবং দালাল গ্রেফতার ইত্যাদি অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী রোহিঙ্গাদের নানা সময়ে প্রশাসন গ্রেফতার করলেও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এলাকার সুশীল মহল দাবী করেছেন রোহিঙ্গারা অপরাধ সংঘটনের পর জেলে গেলেও আইনের নানা ফাঁক-ফোঁকড়ে তারা অল্পদিনের মধ্যেই জেল থেকে বের হয়ে একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যার কারণে এসব অপরাধ থেকে পরিত্রান পাওয়া দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) দিনগত রাত ১টার দিকে উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ক্যাম্প-২ ও ক্যাম্প-৬ এর মাঝামাঝি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোলাগুলিতে সলিম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত সলিম উখিয়ার ক্যাম্প-২, ওয়েস্ট ব্লক-সি/২ এর আবদু শুক্কুরের ছেলে।
গত ১৪ জুন রাতে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে নুর কামাল (২১) নামে এক রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত নুর কামাল টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকের শেড নম্বর ৭৪৩ রুম নমর ৫ এর বাসিন্ধা মোহাম্মদ তৈয়ুবের ছেলে। নুর কামাল বিষপান করেছে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাকে উদ্ধার করে মোচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এনজিও পরিচালিত একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ৯ জুন রাত সাড়ে ৮টার দিকে উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আজিম উদ্দিন নামের এক রোহিঙ্গা নেতাকে (মাঝি) কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এ সময় সৈয়দ করিম (৪০) রহিমুল্লাহ (৩৬) নামের আরো ২ জন রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হন। আহতরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিহত আজিম উদ্দিন ওই ক্যাম্পের নেতা।
গত ১০ জুন দিনগত রাতে উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্প থেকে মোহাম্মদ সমিন (৩০) নামের এক যুবকের হাত-পা বাঁধা রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। মোহাম্মদ সমিন ওই ক্যাম্পের মধুরছড়ার সি ব্লকের বাসিন্দা। ক্যাম্পের বাসিন্দারা সমিনকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে এপিবিএনকে খবর দেয়। পরে তাকে ক্যাম্পের হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার সারা শরীরে আঘাত ও পেটে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএনের পুলিশ সুপার শিহাব কায়সার খান বলেন, ‘একদল দুর্বৃত্ত এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও জবাই করে রোহিঙ্গাদের হেড মাঝি আজিম উদ্দিনকে হত্যা করে। এ সময় তাদের কোপে আরও দুজন গুরুতর আহত হন। নিহত সেলিম কথিত ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) গোষ্ঠীর সমর্থক। ‘মুন্না গ্রুপ’ নামের অপর একটি রোহিঙ্গাগোষ্ঠী তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। আর মুন্না ওরফে মাস্টার মুন্না আলোচিত সন্ত্রাসী মাস্টার নবী হোসেনের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। ঘটনার পরদিন দিবাগত রাতে মাঝি আজিম উদ্দিন হত্যার মামলায় তিন আসামি গ্রেপ্তার করেছে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান (এপিবিএন)। তারা হলো ক্যাম্প-১৯, ব্লক এ/৮ এর বাসিন্দা মৃত মো. সলিমের ছেলে মোঃ হাসিম (৪০), ব্লক- ডি/৬, ক্যাম্প-১৬ এর আব্দুল হাকিমের ছেলে মো. জাবের (৩২) ও ব্লক-সি/৬, ক্যাম্প-১৬ এর মৃত আবুল কাসিমের ছেলে মো. ইলিয়াছ (৪০)। প্রাণপণ দিয়ে আমরা রোহিঙ্গা শিবিরে নানা অপরাধ দমনে কাজ করে যাচ্ছি। দুস্কৃতিকারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে আমরাসহ প্রশাসনের একাধিক বাহিনী মাঠে অক্লান্ত কাজ করছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের দুইগ্রুপের মধ্যে বুধবার রাতে গোলাগুলি হয়। তার মধ্যে একটি গ্রুপ ছিল মুন্না বাহিনীর আর অপর গ্রুপটির নাম জানা যায়নি। বালুর মাঠ আর নৌকার মাঠের মাঝামাঝি স্থানে গোলাগুলির একপর্যায়ে সলিম নামে এক রোহিঙ্গার শরীরে গুলি লাগে। গোলাগুলির খবর পেয়ে এপিবিএন ঘটনাস্থলে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে সলিমকে উদ্ধার করে এমএসএফ হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত তিনটার দিকে তিনি মারা যান। কী কারণে এই গোলাগুলি এবং কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের ধরতে অভিযান চলছে।