

বি এম হাবিব উল্লাহ, চকরিয়া -পেকুয়া (কক্সবাজার) থেকেঃ
কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া সহ সারা দেশে মাছের একদিকে ঘাটতি অন্য দিকে বিপ্লব দেখা দিলেও দিন দিন মুল্য বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে রীতিমত কয়েকদিন পর হলেও অল্প পরিমাণ মাছ খাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ইদানিং আগের অবস্থা নেই। তবে মাছের উৎপাদন বেড়েছে অনেক গুন। সবখানে মাছ পাওয়া গেলেও মূল্য অনেক বেশি। যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরেই চলে যাচ্ছে। সব সময় মাছের মূল্য চড়া। পাঙ্গাশ ও তেলাপিয়া মাছই বাজার গরমের বাইরে। কেজিতে দেড়শ টাকার নিচেও নয়। ইলিশের দাম হাজারের উপর। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ এর মধ্যে। মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দুই এ। তথ্যসুত্রে , বর্তমানে মৎস্য খাতে জিডিপিতে ৪.৭৩%, কৃষিজ জিডিপিতে ২৫.৭২%, দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণীজ আমিষের প্রায় ৬০%। ১৪ লাখ নারীসহ প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। গড়ে দেশের মানুষ মাথাপিছু প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। মৎস্য খাতের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬% রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪.০৪% অর্জিত হচ্ছে মৎস্যজাত পণ্য থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫.৫২ লাখ মে. টন। ৫৬.৭৬% অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ২৮. ১৮% ও সামুদ্রিক ১৫%। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ ৪.৩৯ লক্ষ মে.টন আর ইলিশের উৎপাদন প্রায় ৬ লাখ মে.টন)। দেশের ১২৫টি উপজেলার নদনদীতে ইলিশ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্য মতে, গত ১২ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৮৩%। গত ২০১৬ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া। বিবিসি’র সুত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে মিঠা পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ১৪৩টি মাছই ছোট মাছ। যেসব মাছ আকারে নয় সেন্টিমিটারের ছোট সেগুলোকে ছোট মাছ বা স্মল ইন্ডিজেনাস স্পেসিস কিম্বা এসআইএস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইইউসিএন’র সুত্র বলছে, বাংলাদেশের ৬৪টি প্রজাতির মাছ ইতোমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
তবে চকরিয়া ও পেকুয়ায় উৎপাদন নেই এমন কোন মাছ নেই। বিশেষ করে চিংড়িতো সারা বিশ্ব দরবারে সমাদৃত। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অস্তিত্বের হুমকির মধ্যে পড়া অসংখ্য মাছের বেশ কয়েকটিকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সরকারি তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে মাছ চাষে মহা বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তাই মৎস্য উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে।
দেশে মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। আগের থেকে প্রায় ৩০ গুণ মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে গণভবন লেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করেন। মৎস্য চাষকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার সূচনা করেন। শ্লোগান ছিল, মাছ হবে এ দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ। সে থেকেই মৎস্য চাষ লাভজনক হওয়ায় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মৎস্য চাষে। তাতে কিছু শিক্ষিত মানুষও যুক্ত হয়েছেন। ফসলের জমি কেটে পুকুর বানিয়ে দীঘি-পুকুর-জলাশয় সংস্কার করে এবং বাড়িতে অ্যাকুইরামে ও আঙ্গিনায় চৌবাচ্চা বানিয়ে মৎস্য চাষ করেছেন। চকরিয়া পেকুয়ায় হাজার হাজার হেক্টর ধানী জমি এখন পদ্তীগত মাছের ঘের। তা ছাড়া দেশে যে পরিমান মাছ হয়, তাতে বিশেষ করে শুধু চকরিয়ায় এ যাবত প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার একর সুন্রবন খ্যাত জমিতে কেবল মাছ চাষই হয়ে আসছে। এখানে হয়না উন্নত প্রজাতির এমন কোন মাছ নেই।
অন্য দিকে নদীতে, হাওরে, বিলে ও উপকুলে ভাসমান খাঁচায়ও মৎস্য চাষ করা হচ্ছে বর্তমানে। সরকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন আইন ও পরিবেশ তৈরি করেছেন। বিজ্ঞানীরা বিদেশি মাছের সাথে দেশি মাছের ক্রস করে উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। বিলুপ্তপ্রায় ৩১ প্রজাতির দেশীয় মাছকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছেন তারা। কিন্তু, প্রকৃত উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বড় রকমের গড়মিল থাকলেও বর্তমানে মাছের মুল্যে আগুণ ধরার কথা ছিলনা। বর্তমানে মাছের চড়া দামের জন্য মৎস্যজীবীদের অতি মুনাফাই দায়ী। এ সময়ে চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের ঘাটতিও রয়েছে অনেক। বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে মাছ আমদানি ও চোরাচালানের মাধ্যমে এসে বাজারজাতও হচ্ছে।
মৎস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ জন্য আইন বাস্তবায়ন ও মাছ উৎপাদনে বাধাঁ দূর করতে হবে। আমিষের ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি মাছের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তাই অধিক উৎপাদনশীল মাছ চাষে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মূল্য হ্রাস পাবে। সাধারণ মানুষের মাঝে মাছ খাওয়া বৃদ্ধি পাবে। রপ্তানিও বাড়বে। নদী খাল বিল জলাশয় ও পুকুর সংস্কার করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখা থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ১.৬৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত বিশাল সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক পানি সম্পদে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং ৪৭৫ প্রজাতির মাছ রয়েছে। যার সব গুলোই চকরিয়ায় পাওয়া যায়।
মাছগুলো আহরণ করতে পারলে বর্তমান অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। দেশের সামুদ্রিক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। সামুদ্রিক মৎস্য আইন-২০২০ একাদশ জাতীয় সংসদে ইতোমধ্যে পাস হয়েছে। জাতীয় সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালাও প্রক্রিয়াধীন। বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ২৫টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করা হয়। যা সুত্র বলছে। জৈবিক বিশ্লেষণের ডাটাও সংরক্ষণ করা হয়েছে। সার্ভের মাধ্যমে এরই মধ্যে সর্বমোট ৪৫৭ প্রজাতির মাছ শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে ৩৭৩ প্রজাতির মাছ ২১ প্রজাতির হাঙ্গর ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লব স্টার ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, যে সব কাঁকড়া চকরিয়ায় মিলছে হামেশাই।১ প্রজাতির স্কুইলা ৫ প্রজাতির স্কুইড ৪ প্রজাতির অক্টোপাস ৫ প্রজাতির ক্যাটল মাছ পাওয়া গেছে। ২০২০ সালে গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ আহরণের জন্য নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং জাতীয় সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালা বাস্তবায়ন করা দরকার। উৎপাদনশীল মাছের এলাকায় প্রয়োজনীয় মৎস্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা তথা কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করা দরকার। মাছের ভরা মওসুমে আহরণকৃত মাছ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা না থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ কারনে। বন্যা হলে বিপুল পরিমাণ মাছ ভেসে চলে যায়। মাছ চাষ খুবই লাভজনক। তাই মাছ চাষে আরও অধিক মনোযোগ দেওয়া দরকার। বেকারত্ব দূর হবে মাছ চাষে। কল্যাণ হবে দেশের । তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারি বিভিন্ন সূত্র ও বিশেষজ্ঞ জন এবং কয়েকজন বন্ধু সাংবাদিকের তথ্য সূত্র যুক্ত করা হয়েছে।