
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
সরকারিভাবে নানা ব্যবস্থা নেয়ার বুলি আউড়ালেও কোরবানির চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সষ্টি হয়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে দেশের কোথাও পশুর চামড়া বিক্রি হয়নি। একেবারে পানির দামে চামড়া কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এবারও একশ’ টাকায় গরুর চামড়া ও ৫ টাকায় খাসির চামড়া বিক্রির নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেই চলেছে। মৌসুমী ব্যবসায়িদের খপ্পড়ে যাচ্ছে তাই চামড়ার দাম দেখে ক্ষোভে দুঃখে অনেকেই তাদের অনেকেই কোরবানির পশুর চামড়া ফড়িয়াদের কাছে না বিক্রি করে এতিমখানায় দান করেছেন।
কেন এই বিপর্যয়? সরকার এবার এমনিতেই চামড়ার দাম কম ধরেছে। অন্যবারের চেয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম ২০ থেকে ২৯ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে। বিশ্ব বাজারে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। অন্যদিকে গত বছরের ৭০০ কোটি টাকার চামড়া এখনো অবিক্রিত রয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে আছে চামড়া রপ্তানি। চমড়া কেনার জন্য ৬৮০ কোটি টাকার যে ঋণ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে কাঁচা চামড়া কেনার আড়তদারদের দেয়া হয়েছে মাত্র তিন কোটি টাকা। যার কারণে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি কোথাও।
গত বছর বাংলাদেশে সব মিলিয়ে এক কোটি ১৫ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ কোরবানি হয়, এবার তার চেয়ে ৩৫-৪০ ভাগ কম হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারপরও চামড়ার চাহিদা নেই। চামড়ার পাইকার ব্যবসায়িরাজ জানিয়েছেন, ব্যবসায়িদের হাতে টাকা ছিল না, তাই তেমনভাবে কিনতে পারেনি, চাহিদা কম থাকায় চামড়ার দাম এতটা কমে গেছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসেসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের গত বছরের চামড়ার ৬০ ভাগ এখনো বিক্রি করতে পারিনি। করোনার শুরুতে প্রধান আমদানিকারক চীন চামড়া নেয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর ইটালি, জাপান ও কোরিয়াতেও রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশের চামড়া রপ্তানিকারকরা চরম বিপাকে পড়েছে।
কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড থামানো গেল না : বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে লাখ লাখ পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়। আবার এদেশেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ট্যানারির মালিকেরা বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকার বিদেশি চামড়া। চামড়া নিয়ে এই ভানুমতির খেল একেবারে নতুন নয়। এবারও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড থামানো গেল না। জানা গেছে, চামড়া নৈরাজ্যের পেছনে মূল কারিগর মাঠপর্যায়ের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কোরবানির দিন তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া কেনেন। এ সময় তারা যতটা সম্ভব কম দামে কেনার চেষ্টা করেন। চামড়া পচনশীল হওয়ায় কোরবানি যিনি দেন, তিনি বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করে দেন। আবার ভালো দাম না পেয়ে অনেকে চামড়া ফেলে দেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
চামড়া নিয়ে হতাশ ক্রেতা-বিক্রেতা : চামড়া নিয়ে কোন আশা দেখছেন না ক্রেতা-বিক্রেতারা। আগে কুরবানি ঈদকে নিয়ে গড়ে উঠত মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এখন তা তো খুঁজে পাওয়া যায় না উল্টো চামড়া ব্যবসায়ীদেরও খুঁজতে হয় বিক্রেতাদের।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঈদের দিন চামড়া রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এ পরিস্থিতিতে মাদ্রাসার ছাত্রদেরও খুঁজে পাওয়া যায় না চামড়া দেওয়ার জন্য। চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়িরাও জানান, একটা চামড়া বিক্রি করতে রিকশা ভাড়া দিতে হয় দুই আড়াইশ টাকা। কিন্তু চামড়ার দাম পাওয়া যাবে ৫০০-৬০০ টাকা। আগ্রহ থাকবে কোথা থেকে। আগের মতো পাড়া-মহল্লার চামড়া সংগ্রহ করে কেউ বিক্রি করতে আসে না।
চামড়া নিয়ে বসে থাকা আরিফ নামের একজন বলেন, চামড়াতো মহল্লা থেকে কিনে ফেলেছি। কিন্তু এখন বিক্রি করার জায়গা পাচ্ছি না। দামও পাচ্ছি না। কোরবানিদাতা সুমন মিয়া বলেন, চামড়া কেনার কাউকে পেলাম না। এক মাদ্রাসা থেকে কয়েক জন এসেছে তাদের দিয়ে বেঁচেছি।
আব্দুর রহমান বলেন, দুপুরে কুরবানি দেয়ার পর থেকে কেউ চামড়া কিনতে আসেনি। এলাকায় চামড়া সংগ্রহের কাউকে পাওয়াও যায়নি। পরবর্তীতে চামড়াগুলো দান করে দিয়েছি।
সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা। ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে ও ঢাকায় বকরি ও খাসির চামড়ার দাম একই থাকবে।
কাঁচা চামড়া ঢুকতে শুরু করেছে ট্যানারিতে
ঢাকার সাভারের ট্যানারিগুলোতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচা চামড়া আসতে শুরু করেছে। সাভারের চামড়া শিল্প নগরী ঘুরে দেখা যায় দুপুর ২টার পর থেকেই সেখানকার ট্যানারিগুলোতে ঢাকাসহ এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচা চামড়া নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোরবানির পশুর চামড়া ছাড়ানোর পরপরই প্রত্যেককে নিজ উদ্যোগে চামড়ায় লবণ মাখিয়ে তা সংরক্ষণের আহ্বান জানানো হলেও, দেখা গেছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ এসব চামড়ার অধিকাংশই লবণ ছাড়াই ট্যানারিগুলোতে নিয়ে আসা হচ্ছে।
এদিকে ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয়ের কথা বলা হলেও বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া নিয়ে আসা একাধিক ব্যবসায়ী ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে তারা অভিযোগ করেন, অন্যান্য বারের মতো এবারও সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দিচ্ছে ট্যানারিগুলো। কিন্তু ট্যানারিগুলো বলছে, এ বছর প্রতিটি গরুর কাঁচা চামড়া ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় ক্রয় করা হচ্ছে। লবন মাখানো চামড়া আসতে শুরু করলে তার দাম আরও বাড়বে।