
বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক দেশবাংলাঃ
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪৫ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অফিস, প্রকৌশল অফিস, পরিকল্পনা উন্নয়ন ও ওয়ার্কস অফিস এবং হিসাব অফিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রকল্পের অর্থ আত্মৎসাতের অভিযোগ পাওয়া যায়।
এমনকি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসির) সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. ফেরদৌস জামান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা পর্যন্ত কমিশনের এ টাকা নিয়ে ভাগাভাগি চলে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর একনেক হতে ৩৪৫ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পায় ‘মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ’-শীর্ষক প্রকল্প। প্রকল্পটি ১ জুলাই ২০১৬ হতে ৩০ জুন ২০১৯ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে (আরডিপিপি) সংশোধনীতে প্রকল্পেরমেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে জুন ২০২১ মেয়াদে অনুমোদিত হয়,।বিগত ২৯-৬-২০২১ তারিখে নির্মাণকাজের গুনগতমান নিশ্চিত করাসহ ৫ টি শর্তে আবারও প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০২২ পর্যন্ত করা হয়।
প্রকল্পে নির্ধারিত খাতের বাহিরে বিভিন্ন খাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের অডিট আপত্তির রিপোর্ট অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজের বরাদ্দবিহীন ভাবে প্রকল্পের আওতায় টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইসিটি সেলের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইন্ট্রিমেন্সি কম্পিউটার লিমিটেড এর কাছ থেকে ২৩ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ টাকার যন্ত্রপাতি, ২৫১/১২ নং বিল ভাউচারে ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে ক্রয় করাহয়েছে যার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) অনুযায়ী এখাতে ৩০-০৬-২০১৯ তারিখ পর্যন্ত কোনো বরাদ্দ নেই। প্রকল্পের আওতায় ঊর্ধ্বতন শিক্ষক কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত পাঁচতলা ভবনের ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও ৪ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে, যা অর্থ বিভাগের জারিকৃত বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ বিহীনভাবে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকায় গাড়ি নাভানা ও লিটন মটরস থেকে ক্রয় করেন, যা একনেক সভায় সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বহির্ভূতভাবে রাজস্ব বাজেট হতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭২ টাকা প্রকল্প খাতে নেওয়া হয়, যা অডিট আপত্তি হয়। টেন্ডার ডকুমেন্ট ও পিপিআর-২০০৮ সম্পূর্ণভাবে অমান্য করে ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ৩০-০৬-২০১৯ তারিখ ৫ কোটি ৭৩ লক্ষ ৪৩ হাজার ৭৭২ টাকা অগ্রিম প্রদান করা হয় যাতেও অডিট আপত্তি হয়। ৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্যে ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, ১২ তলা একাডেমিক ভবন, মালটিপারপাস কাজ এই তিন ভবনের কাজ করেন নূরাণী কনস্ট্রাকশন, আসবাবপত্র ক্রয় করেন বনশিল্প কর্পোরেশন,২য় ছাত্রী হল এবং সিনিয়র শিক্ষক ভবনের কাজ করেন মের্সাস ভাউয়াল কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শক্তিশালীকরণ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প হতে ৩য় ছাত্র হলের উধ্বমূখী সম্প্রসারণ (২য় থেকে ৪র্থ তলা) কাজের জন্য ৯ কোটি ৩৮ লক্ষ ১৭ হাজার ৬শ ৩২ টাকা প্রাক্কলিত দরের বিপরীতের ৯.১৪% কমে ৮ কোটি ৫২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৬শত ৩২ টাকায় মের্সাস ভাউয়াল কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে কার্যদেশ হলে কাজটি আরোও কম মূল্যে ৭ কোটি ৩৮ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকায় সম্পন্ন করা হয়েছে। যা প্রাক্কলিত মূল্য অপেক্ষা ২১.৪৩% কম হয়েছে। পিপিআর আইন ২০০৬ এর ১৯(১) এবং পিপিআর বিধি ২০০৮ এর ৩৩(৩) মোতাবেক দরপত্র মূল্য প্রাক্কলিত মূল্যেও ৫% কম বা বেশি হলে উক্ত দরপত্র বাতিল করতে হবে। এসেক্ষেত্রে তা বাতিল করা হয়নি বলে অডিটে আপত্তি হয়।
এছাড়াও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উন্মুক্ত দরপত্র আহবান না করে রাস্তা নির্মাণ বাবদ ১ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা মের্সাস ভাউয়াল কনস্ট্রাকশন নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয় যাতে অডিটে আপত্তি হয়।
মেহের আলী সেকশন অফিসার (স্টোর) প্রকৌশল অফিসের সকল ধরনের মালামাল পরিবহন সংক্রান্ত দুর্নীতির সাথেও জড়িত বলেও অভিযোগ ওঠে। তিনি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী পিপিআর ২০০৮ সম্পুর্ণ লঙ্ঘন করে বিগত ২৯-০৪-২০১৯, ২২-০৩-২০১৯ ও ৩০-০৬-২০১৯ তারিখ মালামাল পরিবহনের জন্য তিন মেয়াদে প্রতিবার ৯৬ হাজার টাকা করে উত্তোলন করে সর্বমোট ২ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে অগ্রিম খরচ করেন। উক্ত অর্থে কোন সংস্থান প্রকল্পের ডিপিপিতে নেই। এজন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তার নামে অডিট আপত্তি হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ত কাজের দুর্নীতির হিসাব অনুযায়ী প্রাক্কলিত মূল্যের ৭% হতে ৫℅ সাবেক ভাইস চ্যান্সেলরপ্রফেসর ড. মোঃ আলাউদ্দিন,বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসির) সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. ফেরদৌস জামান ২%, ১% পিএস আব্দুল্লাহ আল রিপন, ৩% বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান প্রকৌশলী, ৩% প্রকল্প পরিচালক মোস্তফা কামাল এবং ২% নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান এবং ২% উপ-পরিচালক জনাব মোঃ আনোয়ারুল হক এবং ২% বাকিরা অবশিষ্ট অংশ পেয়ে থাকেন।নির্মাণ কাজের প্রতিটি টেন্ডারে কাজ পাওয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাবেক উপাচার্যকে তার অরুনা পল্লীর বাসায় নগদ ১ কোটি টাকা প্রদান করত। যাবতীয় অর্থেরলেনদেন সাবেক উপাচার্যের পিএস আব্দুল্লাহ আল রিপনের তত্ত্বাবধানে ঘটে বলে জানায় একাধিক কর্মকর্তা।
এ সিন্ডিকেটের মূলহোতা হিসেবে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক (পউও) ও উপ-পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল হক ও প্রকৌশলী অফিসের প্রধান প্রকৌশলী মো: আবু তালেব।
প্রকল্পটির আওতায় পণ্য ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে ই-জিপি টেন্ডার বাণিজ্যের মূলহোতা বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক (পউও) ও উপ-পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল হক। টেন্ডারের প্রাক্কলন সংরক্ষণ, ইজিপি সিস্টেমে কাজ ও টেন্ডারের নথি তিনি নিজের কাছে আটকিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
তিনি দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটি ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ছিলেন এবং বর্তমানেও তিনি পদাধিকার বলে উন্মুক্তকরণ কমিটির সদস্য ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব।
টেন্ডার অনলাইনে যাবার পরবর্তী ধাপে তিনি নির্ধারিত ঠিকাদারকে মোবাইল ফোনে ও ই-মেইল এর মাধ্যমে প্রাক্কলিত মূল্যসহ তথ্যাদি সরবরাহ করে থাকে বলে অভিযোগ ওঠে। দরপত্র উন্মুক্তকরণ ও মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হওয়ায় তিনি প্রাক্কলন সুবিধা প্রদানকৃত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ প্রদান করার জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যগণকে নানানভাবে বিপথে পরিচালনা করেন। কাজ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বিভাগ ও অফিসে নিম্নমানের কম্পিউটার, ল্যাব যন্ত্রপাতি, প্রিন্টার, মেডিকেল যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে যা নির্ধারিত এক বছরে বা তার কিছু পরে নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন বিভাগ ও অফিস হতে নানান অভিযোগ আসলেতিনি তা যথাযথভাবে আমলে নেননি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে মেডিকেল সেন্টারে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই বর্তমানে অকেজো যা পরবর্তীতে মেডিকেল সেন্টারে রিকুয়েষ্ট ফর কোটেশন (আরএফকিউ) পদ্ধতিতে রাজস্ব বাজেট হতে ক্রয় করা হয়। তিনি যাতায়াতের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হতে গাড়ি সুবিধা নিয়ে থাকেন এবংকোনভাবে যদি তার পছন্দেরঠিকাদার কাজ না পায় তখন তিনি কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে নানান ধরনের খারাপ আচরণ করেন ও বিল ছাড়ে বিলম্ব করেনবলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট অফিসের এক কর্মকর্তারসূত্রে জানা যায়,টেন্ডারের টাকা নিয়ে বনিবনা না হওয়ায়ইন্ট্রিগেটেড কম্পিউটার ও কমিউনিকেশন লিমিটেড কোম্পানির মালিক শাজাহান মামুন অফিসে এসে তাকে শাসিয়ে নানান ধরনের মন্তব্য করেন। তার অফিস কক্ষে কোম্পানির মালিক দীর্ঘক্ষণ রুদ্ধদ্বার হট্টগোল করেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষকগণ অবগত ও প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীতে কোম্পানিটিকে কাজ প্রদানের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করেন আনোয়ারুল।
২০১৯ সালে প্রকল্পটির পরিচালক মোঃ মোস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় তিনি প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। নিয়মানুযায়ী তিনি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব হন এবং টেন্ডার বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করে অদক্ষ কোম্পানিগুলোকে কাজ দেন। সে সময় তিনি প্রতি বুধবার ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশনসহ নানা দপ্তরে প্রকল্পের কাজে ভ্রমণসূচী অনুমোদন করেন অথচ বেশীর ভাগ সময়ই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গাজীপুরে তার স্ত্রীর কর্মক্ষেত্রে কাটান। তৎকালীন সময়ে তিনি ভুয়া টিএ/ডিএ বিল প্রস্তুত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব খাত হতে অবৈধভাবে আনুমানিক ৬০ হাজার টাকা তসরুপ করেন বলে জানা যায়।
প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির জন্য দুটি প্যাকেজ থাকলেও তিনি তা বিধি বহির্ভূতভাবে দুইয়ের অধিক প্যাকেজ টেন্ডার করেন যাতে অধিক টেন্ডার বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিগত ১১/১২/২০২১ তারিখ প্রকল্প পরিচালক মোঃ মোস্তফা কামাল স্বাস্থ্যগত দীর্ঘ দিনের ছুটিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনোয়ারুল হকের দুর্নীতির কারণে তাকে প্রকল্প পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করেননি। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২২ দিয়ে শেষ হবে জেনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে তথ্য গোপন করেন এবং ৭টি দরপত্র আহ্বান করার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অজানা।
বর্তমানে দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। প্রকল্প পরিচালক ও পরিচালক (পউও) এর দায়িত্ব না পাওয়া সত্বেও প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া প্রকল্প সংক্রান্ত বিষয়ে ইউজিসিতে পরিচালক (পউও) এর দায়িত্বে পত্র পাঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ দপ্তরে পত্র পাঠান যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি বর্হভূত। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগে তথ্য পাঠানোর জন্য এপিএ (বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি) জন্য ইউজিসিতে মনগড়া তথ্য পাঠান। ০৪/০১/২০২২ তারিখের তথ্য অনুয়ায়ী প্রকল্পের আওতায় ছাত্রী হলের নির্মাণকাজ ৮০% সম্পাদিত হয়েছে কিন্তু তিনি ১০০% সম্পাদিত হয়েছে বলে তথ্য প্রদান করেন। প্রকল্পের ডিপার্টমেন্টাল প্রজেক্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটি(ডিপিইসি)সভা ২০/০৫/২০২১ জুমে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত না থেকেও প্রকল্পের সম্মানী/সিটিং ভাতা গ্রহণ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব বাজেটের আওতায় প্রতিবছর অফিস যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ এক কোটি ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের প্রিন্টেড কাগজ ক্রয় বাবদ ২৫ লক্ষ টাকার ই-জিপি টেন্ডার কার্যক্রম তিনি পরিচালনা করেন বলে একাধিক কর্মকর্তা জানান।কাজ দুইটিতে আনোয়ারুল হক, উপ-পরিচালক (বাজেট) মোঃ ফারুক হোসেন,সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলরপ্রফেসর ড. মোঃ আলাউদ্দিন ও তার পিএস মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল রিপনও সক্রিয় অংশীদার। অফিস যন্ত্রপাতির প্রাক্কলন আনোয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করে, ফারুক বিল প্রস্তুত ও চেক সংক্রান্ত কাজ ও পিএস রিপন ভিসিকে ম্যানেজ করেন বলেও অভিযোগ ওঠে।অফিস যন্ত্রপাতির দরপত্র মূল্যায়ন এর ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কোন প্রকার টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন যাচাই কমিটির মতামত ছাড়া কাজ প্রদানের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিকে আনোয়ারুল হক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কাজ হাসিল করেন। অন্যদিকে প্রিন্টেড কাগজ ক্রয়ের জন্য বিগত তিন বছর ধরে তিশা এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে যা আনোয়ারুল হকের ফর্মুলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত দুদক মামলার আসামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবু তালেব পৌরসভার অনুমোদন ব্যতীত, পিপিআর অমান্য, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ভবন নির্মাণ করেন।বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্ব থেকেই তিনি দূর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ০৪/১২/২০০৮ তারিখে দুদক সহকারী পরিচালক শেখ মেসবাহ উদ্দিন দিনাজপুর পৌরসভায় ভুয়া প্রকল্পের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৬২,২৯,৫১২/- টাকা আত্নসাৎতের দায়ে আবু তালেবসহ ২৬ জনের নামে দিনাজপুর কোতয়ালী থানায় মামলা করে। এ মামলায় ২ মাস ২ দিন কারা ভোগের পর জামিন নেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১২/০৩/২০০৯ তারিখে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং ২৫/০৬/২০১১ তারিখে অজ্ঞাত কারণে তিনি স্বপদে কাজে যোগদান করলেও মামলাটি বর্তমানে চলমান রয়েছে।
সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডঃ মোঃ আলাউদ্দিন তাকে দিয়ে প্রকল্পে দুর্নীতির মহোৎসব পালন করার জন্য দুদকের মামলা থাকা সত্ত্বেও আসামীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। তিনি যোগদান করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল অফিস দুর্নীতির আখড়া হিসেবে গড়ে তুলেন। তিনি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সাবেক পরিচালক (পউও) মো: মোস্তফা কামাল এবং অন্যান্য সদস্যগণকে নিজের মতো করে মনোনীত করেন। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনগুলোর দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কমিটিকে বিভিন্ন ভাবে বিপথে পরিচালনা করেন। তার পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ প্রদান করেন। প্রকল্পের আওতাধীন সাতটি নির্মাণ কাজের মধ্যে চারটিই নির্মাণকাজ নূরাণী কনস্ট্রাকশন লিঃএবং বাকি তিনটি মেসার্স ভাওয়াল কনস্ট্রাকশন ও নির্মাণ এসোসিয়েটস (জেভি)কে প্রদান করেন।
আরডিপিপি অনুযায়ী, ১০-তলা প্রশাসনিক অ্যানেক্স উত্তর ভবনের কাজ, ১০ তলা ভিতে ৫ তলা পর্যন্ত মাল্টিপারপাস ভবনের কাজ, ১০ তলা ভিতে ৬ তালায় ছাত্র হল এবং ১২ তলা একাডেমিক কাম রিসার্স ভবনের কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাক্কলিত মূল্য হতে ১০% কমে প্রদান করেন। ২য় ছাত্রী হলের অবশিষ্ট অংশ ৬.৮% কম, সিনিয়র শিক্ষক কর্মকর্তা কোয়ার্টার ৯.৮১% কম, তৃতীয় ছাত্র হল ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ৯.১৪% কমে অন্য এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করেন। ভবনগুলোতে নির্মাণকাজের দুর্নীতি বেগবান করার জন্য অনুমোদিত অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করার লক্ষ্যে প্রকল্পটির আন্তঃঅঙ্গ ব্যয় সমন্বয় করা হয়।
সরকারের আইন অনুযায়ী পৌর এলাকার অভ্যন্তরে সকল সরকারি/সায়ত্বশাসিত/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণের পূর্বে পৌরসভা কর্তৃক নকশা অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে মর্মে স্থানীয় সরকার বিভাগ হতে জারীকৃত আদেশ অমান্য করে প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ভবনগুলোর নকশা অনুমোদন বিহীনভাবে নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। টাঙ্গাইল পৌরসভা বিশ্ববিদ্যালয়কে উক্ত বিষয়ে দুই দুইবার পত্র প্রেরণ করলেও তার কোনো জবাব দেননি সাবেক প্রকল্প পরিচালক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী।
নির্মাণকাজের অনুমোদন বিহীন নকশার কারণে ১৩ মার্চ ২০১৯ তারিখ প্রকল্পের আওতায় মাল্টিপারপাস ভবনের ঢালাই এর সময় ক্যান্টিলিভার পোর্স ভেঙে ১৮ শ্রমিক গুরুতর আহত হয়। উক্ত বিষয়ে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টকোন কর্তৃপক্ষ অবগত নন বলে জানা যায়। ঘটনাটি চাপা দেয়ার জন্য নামে মাত্র তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় যে ঢালাইয়ের ত্রুটির কারণে সমস্যাটি হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী ভবনটির ডিজাইনের পরিবর্তন করে ক্যান্টিলিভার স্লাবের একটি কলাম সাপোর্ট প্রদান করেন। এতে প্রমাণিত হয় ভবনটির ডিজাইনগত ত্রুটি রয়েছে। বিষয়টি নামে মাত্র পউও কমিটির ৪৭তম সভায় টেবিল এজেন্ডা হিসেবে আলোচনা করা হয়। প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি(পিআইসি)সভার সদস্যগণ সভার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসলে নির্মাণাধীন ভবনের সামনে নিম্নমানের ইট, মরিচা পড়া লোহা ও অন্যান্য সামগ্রী দেখে তা তাৎক্ষণিক অপসারণের জন্য প্রকল্প পরিচালকের নির্দেশ দেন। প্রকল্প পরিচালক গত ২৪/০৬/২০১৯ তারিখ উপরোক্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি প্রদান করেন।
সিনিয়র শিক্ষক কর্মকর্তা কোয়ার্টারের নির্মাণকাজ সাম্প্রতি শেষ হয়েছে, ভবনটির কাজের গুণগত মান এর পরীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী স্টোন চিপস এর ক্ষয় ৩১% যা সর্বোচ্চ ৩০% হলে গ্রহণযোগ্য, বালির এফএম এর মান ২.৮২ যা ২.২-২.৬ হলে গ্রহণযোগ্য। কাজটি শেষ হওয়ার পর সিসি সিলিন্ডার টেস্টিং করানো হয় যা কাজটি চুড়ান্ত সমাপ্ত প্রতিবেদনের পরে করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসকল দুর্নীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী আবু তালেবকে তার রুমে তালা বদ্ধ করে রেখে আন্দোলন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলী আবু তালেবের ডানহাত হিসেবে ধরে নেওয়া হয় নির্বাহী প্রকৌশলী (পুরঃ) জনাব মোঃ হাবিবুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী (পুরঃ)জাফর হায়দার, সহকারী প্রকৌশলী (পুরঃ) শফিকুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী (এস্টিমেটর) জনি আহমেদ এবং সেকশন অফিসার (স্টোর) মেহের আলীকে।
নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান এবং আবু তালেবের নিকট আত্মীয় সহকারী প্রকৌশলী শফিকুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীর দুর্নীতির মূল হাতিয়ার। হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন সাবেক উপাচার্য এর ই-জিপি পোর্টাল এ হেড অব দি প্রকিউরিংএনটিটি (হোপ) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাহী প্রকৌশলীর জাফর হায়দারকে প্রতিমাসে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ নেওয়ার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গাড়ি সুবিধা প্রদান করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
প্রকল্পের আওতায় ১২ তলা একাডেমিক ভবনের নকশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশলীর মতবিরোধ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজে ব্যবহারের জন্য ভবনটি ডিজাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়ের যথাযথ দৃষ্টি নির্দেশনা ছাড়াই প্রণয়ন করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ভবনটি নির্মাণ করা হয়।
ইউজিসির সচিব ও পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. ফেরদৌস জামান এর ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক (পউও) মোঃ মোস্তফা কামাল, বিশ^বিদ্যালয় প্রকৌশলী আবু তালেব ও পরিচালক দায়িত্বপ্রাপ্ত (পউও) ও উপ-পরিচালক মোঃ আনোয়ারুল হক এসব কাজ করেন। গত ২৬/০/২০২১ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিফ একাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স অফিসার সাবরিন চৌধুরী মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার অনলাইন চালান ভেরিফিকেশন করতে না পারায় হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কাছে জানতে চায়। এ ঘটনায় সাবরিন চৌধুরীকে সাত দিনের মাঝে বদলি করানো হয় বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র এস এম সিরাজুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে কথা হচ্ছে মিটিংও হয়েছে এখন থেকে তারা পৌরসভার নিয়মনীতি মেনেই ভবিষ্যৎতে কাজ করবেন এবং নিয়মিত পৌরকর দেবেন,।নিমার্ণাধীন ভবন গুলো পৌরসভার নকশা অনুমোদন বিহীন নিমার্ণ কাজ চলমান রয়েছে এব্যাপারে মেয়র বলেন বিশ্ববিদ্যালয় সাথে এ ব্যাপারে সমন্বয় করা হচ্ছে।