
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
টানা তিনবার সহ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগি অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কমিটির পদ লাভে লক্ষ কোটি টাকার বিনিময় এখন আর গোপন কোন বিষয় নয়। রীতিমতো আওয়াজ দিয়েই হাইব্রীড নেতারা টাকা দিয়ে পদ কিনে দলের নাম ভাঙ্গিয়ে টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজীসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। এসব হাইব্রীড ঠেকাতে কেন্দ্র থেকে বারংবার সতর্ক বার্তা প্রদানও করা হয়ে থাকে। তবে পদ পেতে নয়, ক্লীন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের পদ না পাওয়ার জন্য কোটি টাকার মিশন নিয়ে মাঠে সক্রিয় এখন মতিঝিলের ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মিরা। সরেজমিন অনুসন্ধানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
জানা যায়, ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো কান্ডে বিতর্কিত মতিঝিল থানা ও এর অন্তর্গত ৮,৯ ও ১০ নং ওয়ার্ডের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে থানা ও ওয়ার্ডে ৯০ দশকের একাধিক ক্লীন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন। হাইব্রীড নেতাদের কারণে দীর্ঘসময় কোণঠাসা বৃহত্তর মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মিরা ২০১৯ সালে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর নিজেদের স্বচ্ছ ইমেজ নিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ ও এর অধীন ওয়ার্ডগুলোতে সক্রিয় পদচারণা শুরু করলে দলের হাইকমান্ড থেকেও তাদের দলীয় কার্যক্রমে সরব থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হতে থাকে। ফলে বিএনপির সরকার বিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে তাদের উপস্থিতি বেশ গতির সঞ্চার হয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে।
আগামীতে মতিঝিল ও তার পার্শ্ববর্তী থানা (শাহাজাহানপুর, সবুজবাগ ও পল্টন) ও ওয়ার্ডগুলোতে ক্যাসিনো, চাঁদাবাজী ও টেন্ডারবাজীর অভিযোগহীন ক্লীন ইমেজের নেতাদের নিয়েই কমিটি করার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয় দলের হাইকমান্ড থেকে। যার ফলে ১২ সেপ্টেম্বরের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে থানা ও ওয়ার্ডে ৯০ দশকের ক্লীন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা পদ লাভে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ায়। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। মাঝে পেরিয়ে যায় ৬ মাসেরও অধিককাল। এরই মধ্যে কিছুদিন পূর্বে দলের এক সভায় রমজানের পূর্বে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর ও দক্ষিণ) এর কমিটি ঘোষণার জন্য দলের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সময়সীমা বেঁধে দিলে নগর নেতারা কমিটি তৈরীতে দফায় দফায় বৈঠকে বসেন। অলিখিতভাবে জানানো হয় আগামী ২০ মার্চ ২০২৩ এর মধ্যেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর ও দক্ষিন) সকল থানা ও ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণা করা হবে।
এরইমধ্যে গত সাড়ে তিনবছর বিদেশে পলাতক ক্যাসিনোর বরপুত্র ৯ নং ওয়ার্ডের বহিষ্কৃত কাউন্সিলর গোপনে অবৈধ উপায়ে দেশে প্রবেশ করে। প্রশাসন ও দলের উপরমহলের চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়া ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট হাইব্রীড নেতারা ক্যাসিনো ডনের দেশে ফেরার পর থেকে আবারো চাঙ্গা হতে শুরু করে। নিজেদের সংগঠিত ও নিরাপদ রাখতে মতিঝিলের এই ক্যসিনো গ্রুপ আসন্ন কমিটিতে ক্লীন ইমেজের প্রার্থী ঠেকাতে নগর নেতাদের ম্যানেজ করতে কোটি টাকার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, মতিঝিল থানা ও ৯ নং ওয়ার্ডের পূর্বের কমিটির নেতাকর্মি সহ একাধিক হাইব্রীড ও ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট প্রার্থী রয়েছে। পাশপাশি ৯০ দশকের ক্লীন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতার সংখ্যা দু,চারজনের বেশি নয়। ক্যাসিনোর আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীদের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ দুর্বল। তাছাড়া টাকার বিনিময়ে বা তদবীর করে দলের পদলাভে ক্লীন ইমেজের প্রার্থীরা খুব একটা আগ্রহী নন। আর এ সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মাঠে সক্রিয় হয়েছে মতিঝিলের ক্যাসিনো গ্রুপ।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগে ৯০ দশকের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের দুয়েকজন ছাড়া এমনও আছেন যারা ঐসময় ক্লীন ইমেজের থাকলেও এরই মধ্যে টেন্ডারবাজী আর ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আরামবাগ-ফকিরাপুলের বিভিন্ন ক্লাবের কমিটি গঠনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন। যা নিয়ে দেশের একাধিক জাতীয় দৈনিকে ইতিমধ্যে বিস্তর সংবাদও প্রকাশ হয়েছে।
আর যারা এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল থেকে দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের যেন কিছুতেই পদ না দেয়া হয় সেলক্ষেই নগর নেতাদের পিছনে কোটি টাকা নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে মতিঝিলের ক্যাসিনো গ্রুপ। ক্যাসিনো গ্রুপের চাওয়া পূর্বের কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতার সাথে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্য থেকে বর্তমানে এক ঠিকাদার নেতাকেই যেন পদায়ন করেন নগর নেতারা। কেননা এতে করে তাদের পক্ষে আগামীতে আবারো সংগঠিত থাকা সম্ভবপর হবে বলে তারা মনে করে। ২০১৯ পূর্ববর্তী সময়ে ক্লাবপাড়ায় যুবলীগ নেতাকর্মিদের দিয়ে ক্যাসিনো পরিচালিত হলেও পর্দার আড়াল থেকে থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। আর যে কারনেই ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট নেতারা এখনো চান পূর্বের কমিটির নেতারাই যেন বহাল থাকে এবারো।
তবে এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও ক্লীন ইমেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বিষয়ে জোড়ালো সুপারিশ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ি, মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের একাধিক সাধারন সম্পাদক প্রার্থীর মধ্যে ৯০ দশকের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদেরই ১ম অবস্থানে তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে সর্বোচ্চ ক্লীন ইমেজের প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদেরই তালিকার প্রথমে রাখা হয়েছে। এমনটাই জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মহানগর আওয়ামী লীগ তাদের রিপোর্ট অনুযায়ি কমিটি করবেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে গোয়েন্দা কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, রাষ্ট্রের কল্যানে আমরা কাজ করি। কোন দলের কলানের জন্য চিন্তা করা আমাদের কাজ নয়। দল তার পছন্দ অনুযায়ি নেতা নির্বাচন করবেন। আমরা সে বিষয়ে রিপোর্ট দিয়ে তাদের সহযোগিতা করি মাত্র। নির্বাচিত কোন নেতা যদি ভবিষ্যতে অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত হয় তাতে গোয়ন্দা সংস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সুনাম ক্ষুন্ন হবেনা। সুনাম ক্ষুন্ন হবে দলেরই। অপরাধী নেতাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অবশ্যই বিচারের মুখোমুখী করতে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। তাই দলের ভবিষ্যত সুনামের দিকে লক্ষ্য রেখেই দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত নেতারা তাদের সিদ্ধান্ত নিবেন এমনটাই আমরা আশা করবো। অন্যথায় যেকোন পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ি থাকবেন।
এ প্রসঙ্গে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগ ও এর অন্তর্গত ওয়ার্ড কমিটি গঠনের দায়িত্ত্বে থাকা ঢাকা-৮ সাংগঠনিক টিমের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, যারা টাকা নিয়ে নগর নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। শতভাগ ক্লীন ইমেজের নেতাকর্মিদের নিয়েই এবারের মতিঝিল থানা আর ওয়ার্ডের কমিটি হবে। ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট দুরের কথা, কোন টেন্ডাবাজ, চাঁদাবাজ আর হাইব্রীড এবারের কমিটিতে জায়গা পাবেনা নিশ্চিত থাকুন। এরপরেও কমিটি ঘোষণার পরে কেউ যদি প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযোগ দিতে পারে তবে আমরাও সে অনুযায়ি ব্যবস্থা নিবো।
ইতিপূর্বে ৯ নং ওয়ার্ডের সার্চ কমিটি ও ইউনিট কমিটিতে বেশিরভাগই হাইব্রীড আর ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট বলে সব মহলে আলোচনা চলছে, তাহলে থানা ও ওয়ার্ড কমিটিতে এমন হবেনা তার নিশ্চয়তা কি, জানতে চাইলে এই নেতা বলেন, আপনি খোঁজ নিলে দেখবেন ৯ নং ওয়ার্ডের দুয়েকটা ইউনিট কমিটি অভিযোগের ভিত্তিতে স্থগিত করা হয়েছে। তাছাড়া ইউনিট কমিটির চাইতে থানা কমিটি গঠনে অধিকতর সতর্কতা অনুসরন করা হয়েছে। আশা করি আপনারা নিরাশ হবেননা। ভালো ভালো লোকদের নিয়েই থানা কমিটি করা হবে।