
তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি:
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের দ্বিতীয় পর্যায়ের অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান-কর্মসূচির ৩৪টি প্রকল্পের ২ কোটি ৩৯ লাখ ৪ হাজার টাকা হরিলুটের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে,সরকারের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ২৮-০৪-২০২২ তারিখের ৫১.০১.০০০০.০১৯.৯৬.০০৭.২১-(অংশ-১)-১৫২ নং স্মারকে উপজেলার অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসৃজনের লক্ষ্যে তাড়াইল উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ৩৪টি প্রকল্পে মোট ২কোটি ৩৯লক্ষ ৪হাজার টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়।ওইসব প্রকল্পের মধ্যে তালজাঙ্গা ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পে ৩০লক্ষ ৭২হাজার,রাউতি ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পে ৩৭লক্ষ ৭৬হাজার, ধলা ইউনিয়নে ৩টি প্রকল্পে ৩২লক্ষ ৪৮হাজার, জাওয়ার ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পে ৩২লক্ষ ৯৬হাজার, দামিহা ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ৪২লক্ষ ৫৬হাজার, দিগদাইড় ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্পে ৩০লক্ষ ৫৬হাজার এবং তাড়াইল-সাচাইল (সদর) ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্পের বিপরীতে ৩২লক্ষ টাকা বরাদ্ধ দেয় সরকার। কিন্তু ওইসব প্রকল্পে স্থানীয় ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানগণের যোগসাজসে কোনো কোনোপ্রকল্পে আংশিক কাজ করেই পুরো টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া এরকম প্রকল্পও আছে যেখানে বিন্দু পরিমানও কাজ হয়নি। অথচ বিল উত্তোলন করেছেন স্ব-স্ব প্রকল্পের সভাপতি।
তাড়াইল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছর তাড়াইল উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৪৯৪ জন হত দরিদ্র এ কর্মসূচীর আওতায় এসেছেন। এজন্য বরাদ্দ ছিল২কোটি ৩৯ লাখ ৪ হাজার টাকা। নীতিমালা অনুযায়ী কাজ শেষে এসব টাকা শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে পাঠানো হবে। আর এজন্য প্রত্যেক শ্রমিককে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে রকেট একাউন্টও করা হয়েছে। অভিযোগ মতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এককালীন নামমাত্র টাকার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে কিংবা নগদে দিয়ে এসব রকেট একাউন্ট করা মোবাইল সিম হতদরিদ্র লোকজনের কাছ থেকে নিজ জিম্মায় নিয়ে গেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
গোপন সূত্রের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিন পরিদর্শন ও অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের মাগুরী ভূঞা বাড়ির মসজিদের সামনে হইতে ছনকান্দা পর্যন্ত চলমান প্রকল্পে ১০১ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও কোনো শ্রমিকের সাক্ষাত মেলেনি। এলাকাবাসী জানায় এ রাস্তায় ইউপি চেয়ারম্যান একে মাইনুজ্জামান নবাব কোনো কাজই করেননি।
এছাড়া তাড়াইল-সাচাইল সদর ইউনিয়নের সাররং বড় জাঙ্গাল হইতে রমজান ভুঁইয়ার জমি পর্যন্ত চলমান প্রকল্পে ৫০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও কোনো শ্রমিকের হদিস মেলেনি। ধলা ইউনিয়নের দক্ষিণ ধলা বকুলের বাড়ি হইতে সীমের খাল ব্রীজ ভায়া কলুমা পাকা রাস্তা পর্যন্ত রাস্তার কাজে ৬৮ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও কোনো শ্রমিক পাওয়া যায়নি। তালজাঙ্গা ইউনিয়নের বান্দুলদিয়া আব্বাছিয়া মাদরাসা হইতে আসলামের বাড়ি হইয়া ফুকরার বাপের কালভার্ট ভায়া ওয়াহেদ আলীর দোকান পর্যন্ত ৩২ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও এলাকাবাসীর সাথে কথা হলে তারা বলেন, চেয়ারম্যান কিংবা অত্র ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এই রাস্তায় মাটি ভরাটের কোনো কাজই করেননি।
এব্যাপারে তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একে মাইনুজ্জামান নবাবের সঙ্গে কথা বলতে কয়েকবার ফোন করার পর এক ছেলে রিসিভ করে বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব মোবাইল বাসায় রেখে বাইরে আছেন!!উপজেলার তালজাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু জাহেদ ভুঁইয়ার সঙ্গে কথা বলতে তার মোবাইলে কল দিলে তিনি রিসিভ করেন। এ সময় তার ইউনিয়নের ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচী প্রকল্পের কাজ শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু দিয়ে কাটা হয়েছে এবং নামমাত্র টাকার প্রতিশ্রুতিতে শ্রমিকদের রকেট একাউন্টের সিম প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জিম্মায় নিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি এসব অর্থ লুটপাট প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে ইশারা-ইঙ্গিতে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে বলেন, দেশ যেভাবে চলে সবাই তো এভাবেই চলি। যদি একেবারে একশতে একশ হতো তাহলে কী আপনাদের আমাদের কাছ পর্যন্ত আসতে হতো?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বেশ ক’জন মানবাধিকার ও সমাজকর্মী বলেছেন, এ প্রকল্পের এমন নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা প্রশাসন ও এলাকাবাসীর কাছে ‘ওপেনসিক্রেট’। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দাপটের কারণে এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলা এবং আন্দোলন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে, নাম গোপন রাখা ভুক্তভোগীরা জানান, এ কর্মসূচি থেকে নাম বাদ দেওয়ার ভয়ে এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করতে এমনকি মুখ খুলতে পারছেন না তারা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস.এম আবু মোতালেব বলেন, তাড়াইল উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ২০২১-২২ অর্থ বছরের অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান-কর্মসূচি প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমান সময়ে ২শ’ টাকায় শ্রমিক না পাওয়ায় ভেকু দিয়ে মাঠি কাটা হয়েছে আমি তা দেখেছি। করার কিছুই নেই। আপনাদের পারস্পরিক যোগসাজশেই এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে অভিযোগ রয়েছে বললে-তিনি এমন অভিযোগও মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন। এ সময় তিনি আরো জানান, প্রকল্পের কাজ শেষ এবং শ্রমিকদের এ কাজের টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব এখন জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই।
তাড়াইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুবনা শারমিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) ২য় পর্যায়ের কাজ শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু দিয়ে করানোর এবং শ্রমিকের মজুরির টাকা আত্মসাতের কোনো সুযোগ নেই। তবে এমন অভিনব কৌশলে এ কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের মতো নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে এবং অভিযোগ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।