
দিপংকর রায়ঃ
দিনাজপুর থেকে বোচাগঞ্জ মহাসড়ক হয়ে মঙ্গলপুর বাজারে পৌছে দীপশিখা(গনআলয়) বলে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সবাই বলে দিবেন কোন দিকে যেতে হবে বা যাওয়ার জন্য ব্যাটারি চালিত ভ্যান , আটোরিক্সায় পৌছে যাবেন।
প্রকৃতির মনোরম পরিবেশের সাথে মাটির তৈরী দৃষ্টিনন্দন ৩টি স্থাপনা যেন অপরুপ ভঙ্গিতে ঠাই দাঁড়িয়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীদের মনের খোরাকের সাথে মাটির তৈরী এই শৈল্পিক স্থাপনা গুলোর মেলবন্ধন হাজারো দর্শনার্থীদের মনোমুগ্ধ আর আত্মতৃপ্তি দিতে যেন অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত থাকে সবসময়।
এই মন্ত্রমুগ্ধময় পরিবেশের দৃষ্টির স্বাদ নিতে গেলে জেলা শহর থেকে দীপশিখায়(গনআলয়) পৌছাতে পাড়ি দিতে হবে। পিচ ঢালা প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকারাস্তা। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামে অবস্থিত এই গনআলয়।
দীপশিখা মেটি, দেশী ও আনন্দালয় নামে স্থাপনা গুলো শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রতিবন্ধীদের ফিজিওথেরাপি সেন্টার বা পূনর্বাসন কেন্দ্র
হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইমারত গুলো তিন ধাপে নির্মান করা হয়।জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এই কে রোওয়ার্গ নকশা করেন।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানির “শান্তি” নামের এক দাতাসংস্থার অর্থায়নে “মেটি ” ৮,০০০ বর্গফুটের ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়। কাদা মাটির তৈরী ৯ ফুট উচ্চতার প্রথম তলার উপরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী করা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ১০ ফুট উচ্চতার দ্বিতল এই ভবন। ভবনটি নির্মানে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় ১৯ জন শ্রমিক মিলে ইমারতটি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
২০০৮ ও ২০১৮ সালে স্থপতি আন্না হেরিংগার দ্বিতল ৭ কক্ষ বিশিষ্ট ২৭৯০(দেশী) বর্গফুট এবং ৫৫০০ বর্গফুট ( আনন্দালয়) ভবন গুলো পর্যায়ক্রমে অস্ট্রিয়ার লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থীর সাথে স্থানীয় বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ২৫ জন শ্রমিক মিলে প্রায় ৯ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মান কাজ সম্পন্ন করেন।
ভবন গুলো প্রাকৃতিক উপকরণ যথা মাটি, বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরী করা হয়েছে যা প্রকৃতির উপরকোন প্রকার বিরূপ প্রভাব ফেলবে না এমন ভাবেই তৈরী করা। প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে তৈরী করায় ভবনটির কক্ষগুলো গরমের সময় শীতল এবং শীতকালে তুলনামূলক ভাবে গরম থাকায় এটির ব্যবহার বেশ আরামদায়ক। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে এধরনের পরিবেশ বান্ধব এবংপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ এর শতভাগ সোলার সিস্টেম এর মাধ্যেমে সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।
দৃষ্টিনন্দন এই ভবন গুলো নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়ালের ভিতের ওপর দেওয়া হয়েছে আর্দ্রতারোধক। দেয়ালের প্লাস্টারে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। ওয়াটারপ্রুফ হিসেবে মেঝের প্লাস্টারের পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। বাইরে থেকে প্লাস্টার করা হয়নি। ছাদ হিসেবে বাঁশ বিছিয়ে ও বাঁশের চাটাই দিয়ে মাটির আবরণ দেওয়া হয়েছে। ছাদে বাঁশের সাথে কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাঁশ দীর্ঘস্থায়ী করা হয়েছে। ওপরে বৃষ্টির পানি প্রতিরোধ করার জন্য দেওয়া হয়েছে টিন। কোথাও ইট ব্যবহার করা না হলেও ঘরের কাঠামো হিসেবে ইট ব্যবহার করা হয়েছে।
এই নির্মানশৈলী ও দৃষ্টি নন্দনন্দন স্থাপনাগুলো ইতিমধ্যে স্বীকৃতি স্বরুপ অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক “কারি স্টোন নকশা”, ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার কমিউনিটি এ্যাওয়ার্ড ও প্রিক্স সোলারি সিসুই ( সুইজারল্যান্ড) কতৃক পুরষ্কার ও সন্মান।