
সোহেল সামিঃ
পাশের ছিটে বসা বৃদ্ধ লোকটির সাথে হেলপারের তুমুল ঝগড়া। লোকটি শাহবাগ থেকে উঠেছে, নামবে কাকরাইল মোড়ে। ভাড়া ১৫ টাকা। মাত্র দেড় কিলোমিটার পথ, ভদ্রলোক কিছুতেই দেবে না, হেলপারও ছাড়ে না। যেহেতু পথে ঢাকা ক্লাবের সামনে থেকে একবার চেকারের দেখা মিলেছে, ১৫ টাকাই দিতে হবে, এখানে হেলপারের কিছুই করার নাই। কথায় কথায় গন্তব্য চলে আসায়, ১৫ টাকা দিয়েই ভদ্রলোকটিকে গাড়ি থেকে নামতে হলো। মাঝে পাবলিক পরিবহনে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকার কথা এসেছে, হয়েছে সেই সরকারেরই নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ভাড়ার হিসাব। লোকটির সব হিসাবই ম্লান হয়ে পড়েছে বাস মালিকের বসানো চেকার নামক লোকটির এক কলমের খোঁচায়।
শাহবাগের মোড় থেকে ‘তরঙ্গ প্লাস’ নামের এই লাল গাড়িটিতে বাকি ৩ জন যাত্রির সাথে আমিও উঠেছিলাম। বয়স্ক লোকটি তো আগেই কাকরাইল নামলেন, অন্য দুইজন নামবে শান্তিনগর মোড়ে। লম্বা চুলওয়ালা এই দুই যুবক কে আমি আগে থেকে চিনি, বামপন্থী রাজনীতির করে। ওদের সাথেও হেলপারের ঝগড়া হচ্ছে, যথারীতি ভাড়া নিয়েই। ছেলে দু’টির যুক্তি হলো- সাইন্সল্যাব থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত তরঙ্গ প্লাসের নির্ধারিত ভাড়া জনপ্রতি ১৫ টাকা, সেখানে শাহবাগ থেকে শান্তিনগর মোড়, অর্ধেক রাস্তা, ভাড়া হবে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৮ টাকা করে ১৬ টাকা। সেই জায়গায় তারা দুই জনে ২০ টাকা দিয়ে, এক রকমের জোর করে নেমে পড়লেন। বাকি ১০ টাকা নিজ থেকে ভরার অজুহাতে হেলপারের সে কি চিৎকার। বিষয়টি এমন- যেহেতু পথে ঢাকা ক্লাবের সামনে থেকে চেকার একবার গননা করে ফেলেছে, সুতরাং যে যেখানেই নামুক, সবার জন্য ১৫ টাকা ভাড়া বৈধ হয়ে গেছে। এক জনও কম দিলে, সেটি হেলপারের পকেট থেকে যাবে, বেচারা গরীব মানুষ, কেন তার পেটে লাত্থি?
জ্যাম-জুম ঠেলে, অনেকটা পথ পেড়িয়ে, মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নতুন আরেকটি চেকারের সাক্ষাৎ পেলাম। তাকে দেখে বাসের সকল ছাত্র-ছাত্রী হাত উঁচিয়ে হাজিরা দিলো। যাকে সন্দেহ হচ্ছে, চেকার সাহেব তার আইডি কাডটা পরখ করে দেখছেন। এর আগে ঢাকা ক্লাবের সামনেও একই দৃশ্যের অবতারণা হতে দেখেছি। রাজধানীর যত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রী আছে, পাবলিক বাসে চলাচল করে, প্রতিদিন এভাবে হাত উচ্চে তুলে ধরছে। একবার দুবার নয়, কাউকে কাউকে চার পাঁচবার করে হাত শূন্যে তুলে ধরে চেকারের কাছ থেকে হাফ পাশ নিতে হচ্ছে।
একটু সামনে, আধা কিলোমিটার হবে, ফ্লাই ওভারের যে অংশটি মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় মিশেছে, সেখানটায় আমি নামলাম। এই হাফ কিলোমিটার আসার জন্য আমাকে অতিরিক্ত ১০ টাকা গুনতে হয়। তা না হলে রেলগেটের ঐ চেকার দেখার আগেই নামতে হবে, বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে। নিম্ন আয়ের অনেককেই দশ টাকা বাঁচাতে হেঁটে যেতে দেখেছি, হাতে সময় থাকলে আমিও তাই করি। হাটি আর উপভোগ করি, সারাদিন কাজ-কাম করা ঘর্মাক্ত মানুষগুলোর দশ টাকা বাঁচানোর সংগ্রাম।
পথের ঘটনা পরম্পরা আর অতিরিক্ত গরমে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। ইতোমধ্যে, মাঝে দুই চেকার মিলে আমার বিল করে দিয়েছে ২৫ টাকা। শাহবাগের টা ১৫, আধা কিলোমিটার আগে মালিবাগ রেল গেটের টা ১০, সব মিলে ২৫। যেদিন মানিব্যাগে টান থাকে, আমিও ঝগড়া করি। মাত্র আধা কিলোমিটারের জন্য ১০ টাকা, মানতে কষ্ট হয়, ভেতরটা কচকচ করে। কোন দিনই কাজ হয় না, হেলপারের আঙ্গুল ঐ এক দিকে- ‘চেকার’।
ডিআইটি রোড ধরে হাটতে হাটতে কথা হচ্ছিল, আব্দুর রহমান নামের এক ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ির সাথে। একই বাস থেকে আমরা নেমেছি। তরঙ্গ প্লাস অথবা রমজান গাড়িতে করে প্রতিদিন রামপুরা থেকে নিউমার্কেট যাতায়াত তার, সেখানেই দোকান। লোকটি বলছিলেন- মালিকেরা আমাদের বুঝিয়েছে, গাড়ির কর্মচারীদের চুরি রোধে এই চেকার। এক চেকার থেকে আরেক চেকারের মধ্যবর্তী দূরত্ব দেখিয়ে বুঝিয়েছে, কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া মোটামুটি ঠিক আছে। মাঝের স্টপেজ গুলোর যাত্রীদের পকেট কেটে যে ত্যানা ত্যানা করে দেওয়া হচ্ছে, প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে চেকারের নাম করে, সেটা কারো চোখে পড়ছে না।
কথা হচ্ছিলো মৌচাক থেকে নিয়মিত যাতায়াত করা, ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অনিক প্রামাণিকের সাথে। তিনি বলছিলেন- গণপরিবহনের নামে এমনিতেও সব জায়গায় থামিয়ে লোক ওঠা নামা করানো হয়, টিকেট সিস্টেম করে মোড়ে মোড়ে কাউন্টার করে দিলে, অথবা হেলপারের হাতে বই ধরিয়ে দিলে, সমস্যা থাকবে না। ছাত্রদের জন্য থাকবে আলাদা টিকেট। তাহলে চেকার নামক ভদ্রলোকের সামনে হাত তুলে দাড়িয়ে থাকার লজ্জা থেকে আমরা রেহাই পাবো।