
বগুড়া অফিস :
বগুড়ায় শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় শিক্ষার্থীর মা’কে জজের পা ধরানো হয়। সে ঘটনায় এবার বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনকে ওএসডি করে ঢাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তায় পদায়ন করা হয়েছে। এতে করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাবেয়া খাতুনের ১৬ বছরের রাজত্বের অবসান ঘটল বলে মনে করছেন অভিভাবক মহল। রোববার (৯ এপ্রিল) মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে রাবেয়া খাতুনকে ওএসডি করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাবেয়া খাতুন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন তিনি। সেই থেকে টানা ১৬ বছরের বেশি সময় একই পদে অবস্থান করেছেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ পাশেই বগুড়া জিলা স্কুলে এই সময়ে ৬ জন প্রধান শিক্ষক বদলি হয়েছেন।
বগুড়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হযরত আলী জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ দ্বিতীয় শ্রেণির। যেকোনো দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তার ক্ষেত্রে একই কর্মস্থলে টানা সর্বোচ্চ চার বছর থাকার বিধান রয়েছে। বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এক যুগের বেশি সময় ধরে একই প্রতিষ্ঠানে ছিলেন।
এদিকে ওএসডি হওয়ার কয়েকদিন আগে তদন্ত চলাকালীন সময়ে রাবেয়া খাতুন জানিয়ে ছিলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন। ভুল বোঝাবুঝি হওয়ায় তারা শিক্ষার্থীরা নানা কথা বলছে। তবে দোষ নিয়ে বিদ্যালয় থেকে যেতে চাই না। এদিকে সোমবার দুপুরের পর তার মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
একই প্রতিষ্ঠানে ১৬ বছর একজন প্রধান শিক্ষক রয়েছেন এবিষয়ে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম জানান, প্রধান শিক্ষক কিভাবে ১৬ বছর এই পদে তা জানা ছিল না। তবে কিভাবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাকে রেখেছে সে বিষয়ে খোঁজ খবর তিনি নিবেন। তদন্ত শেষে প্রকৃত বিষয়টি প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নিজেরাই পালা করে তাদের শ্রেণি কক্ষ ঝাড়ু দেয়। গত ২০ মার্চ অষ্টম শ্রেণির পাঁচজন শিক্ষার্থীর ঝাড়ু দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বিচারক বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিনের কন্যা ঝাড়ু দিতে রাজি হয়নি। এ নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে বিচারকের মেয়ের কথা কাটাকাটি হয়। পরে ওইদিন রাতে বিচারকের মেয়ে স্কুলের একটি ফেসবুক গ্রুপে ঝাড়ু দেওয়ার বিষয় নিয়ে আপত্তিকর কিছু কথা লিখে পোস্ট দেয়। তার পর সেই পোস্টের নিচে তার সহপাঠীসহ অন্যরা জারাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে পাল্টা লিখতে শুরু করে। পরবর্তীতে সেই নারী বিচারক গত ২১ মার্চ মঙ্গলবার সকালে বিদ্যালয়ে গিয়ে ফেসবুক গ্রুপে তাকে এবং তার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে অসম্মানজক কথা লেখায় শিক্ষকদের মাধ্যমে কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ডেকে নেন।
২১ মার্চ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ফেসবুক গ্রুপে বিচারক এবং তার মেয়েকে নিয়ে অসম্মানজক কথা লেখার কারণে অভিভাবকদের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বিচারক এবং তার মেয়েকে নিয়ে ফেসবুক গ্রুপে অসম্মানজনক লেখা ঠিক হয়নি উল্লেখ করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন এক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে বিচারকের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা ওই বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে বিদ্যালয়ের সামনে সড়ক দুই দফা অবরোধ করেন।
পরে রাতে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল ইসলাম রাত ৯টার দিকে জেলা জজের সঙ্গে কথা বলে ওই বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বাড়ি ফিরে যায়। পরে ওই ঘটনা তদন্তের জন্য বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা শিক্ষা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নিলুফা ইয়াছমিনকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
ওই ঘটনার দুই দিনের মাথায় গত ২৩ মার্চ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিনের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। এরপর গত ২৭ মার্চ তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত শুরু করে। তবে তদন্ত শুরু করার একদিন পরই গত ২৮ মার্চ রাতে বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিন গণমাধ্যমে এক বিবৃতি দেন। ৩ পৃষ্ঠার সেই বিবৃতিতে কাউকে পা ধরতে বাধ্য করেননি দাবি করে উল্টো তিনি তার মেয়ের দুই সহপাঠীর বিরুদ্ধে র্যাগিং এবং বুলিংয়ের অভিযোগ উত্থাপন করেন।
ওই বিবৃতি প্রচারের কয়েকদিন পর ২১ মার্চ বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করানো সংক্রান্ত ঘটনার বর্ণনা সম্বলিত একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়।