

বগুড়া ব্যুরো :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তির সুযোগ পাওয়া বগুড়ার দরিদ্র শিক্ষার্থী মমতা খাতুনের পড়াশোনার খরচ বহন করার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় তার নিজ কার্যালয়ে মমতার ঢাবিতে ভর্তির জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন তিনি। এছাড়া ঈদুল আজহা উপলক্ষে মমতা এবং তার মায়ের জন্য ঈদ উপহার তুলে দেন পুলিশ সুপার। পুলিশ সুপার মমতার পড়াশুনা সংক্রান্ত সব ধরণের সহযোগিতার মাধ্যমে পাশে থাকার আশ্বাস দেন। এ সময় জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মোতাহার হোসেন এবং সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরাফত ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়া সদরের বেলগাড়ী গ্রামে মঞ্জুয়ারা বেগম ২০০২ সালের ১৫ মার্চ জন্ম দেন কন্যা সন্তান। মা স্নেহ ভালবাসায় নাম দেন মমতা। মমতাকে জন্ম দেয়াই মঞ্জুয়ারার জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। যেন মহা অন্যায় করেছে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে। এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের পর জন্ম হয় মমতা’র। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় পিতা রমিজ উদ্দিন রাগে ক্ষোভে কয়েকদিন পরেই তার প্রতিবন্ধী এক ছেলে, সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যা মমতা ও স্ত্রীকে রেখে বড় দুই ছেলে-মেয়ে কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান অজানার উদ্দেশ্যে। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন রমিজ উদ্দিন।
স্বামী চলে যাওয়ায় প্রতিবন্ধী ছেলে ও সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যাকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মঞ্জুয়ারা। একেতো প্রতিবন্ধী ছেলে অপরদিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যা। দারিদ্রতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে এদের জীবন পার করতে হয়। বাবা ফেলে গেলেও কিন্তু জীবনের চাকা থেমে থাকেনি। কোলের সন্তান নিয়েই মঞ্জুয়ারা ঢালাই কারখানাতে কাজ শুরু করেন। যতটুকু উপার্জন করেন তাই নিয়ে দু-একবেলা খেয়ে-না খেয়ে প্রতিবন্ধী ছেলে ও মমতাকে লালন-পালন করতে থাকেন। বড় হতে থাকে মমতা, পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করে দেন বেলগাড়ী ব্র্যাক স্কুলে, সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে প্রাথমিক লেভেলেও ফলাফল ভাল করেন।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে ফাঁপোর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। দারিদ্রতার চরম পর্যায়ে থাকলেও মমতা সাহস হারাননি। অনেক কষ্টে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে টাকা সংগ্রহ করে আদর্শ ডিগ্রী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় মমতা। তার পড়াশোনার আগ্রহ ও মনোযোগী দেখে কলেজের শিক্ষকেরাও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেন মমতাকে।
কিছুদিন আগে তারা বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছে। তার আগে বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। কাঁচের বোতলে কেরোসিন তেল তুলে আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করেছেন মমতা খাতুন। অবশেষে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন মমতা।
তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই লক্ষ্যে ফর্ম তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ভর্তি যুদ্ধে নেমে পড়েন মমতা, শেষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ঢাবিতে খ ইউনিটে মেধা তালিকায় ১০৪০তম অবস্থান করেন। এখন তার ঢাবিতে ভর্তির জন্য জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পুলিশ সুপার সুদীপ কুমারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মমতা বলেন, ‘আমি লেখাপড়া করে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে চাই। লেখাপড়া শেষে একটা ভালো চাকরি করে দুর্নীতি রোধ করতে চাই। আর আমি কন্যা সন্তান হয়ে জন্মেছি বলে, অবহেলা করে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, আমি বাবার কোনদিন আদর পাইনি, এমনকি তাকে বাবা বলে ডাকতেও পারিনি। তাই সমাজে আমার মত যারা অবহেলিত আছে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অবহেলিত সন্তানদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে চাই।’