
এস.এম.মনির হোসেন জীবন**
★স্বপ্নের মেট্রোরেলের সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ।
★দ্রুত এগিয়ে চলছে সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ।
★মেট্রোরেল এক্সিবিশন এবং তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ।
★মেট্রোরেল চালু হলে রাজধানীর চেহারা বদলে যাবে।
★মোট ২৪ সেট ট্রেনের মধ্যে ১২ সেট ট্রেন দেশে এসেছে।
★চলতি বছরের ডিসেম্বরে দেশে প্রথম মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা
★স্বপ্নের মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ এ মাসেই শেষ হচ্ছে
রাজধানীবাসির স্বস্তি। রাস্তায় সীমাহীন যানজটের কবল থেকে নগরবাসির মুক্তি ও দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব করতে চলতি বছরের ডিসেম্বরে দেশের প্রথম স্বপ্নের মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালুর পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহন করেছে সরকার। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মেট্রোরেল চালুর সামান্য কিছু কাজ বাকী রয়েছে এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে মেট্রোরেলের সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর ১০ আর কাজিপাড়া এলাকায় মেট্রো রেলের দু’টি সিঁড়ি প্রায় ৫ শতাংশ কাজ এখনও বাকী রয়েছে।
উত্তরা-আগারগাঁও অংশের মেট্রোরেলের অবকাঠামো গত নির্মাণকাজ এ মাসেই শতভাগ শেষ হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্র ও মেট্রোরেল প্রকল্পের একাধিক তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের অবকাঠামো নির্মাণকাজ। দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের আগারগাঁওয়ের এ পথ এরইমধ্যে নগরবাসীর নজর কেড়েছে। পথের দুই ধার ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে।
দ্রুত এগিয়ে চলছে সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ ও । এই অংশে এখন বাকি শুধু মিরপুর ১০ নম্বর ও কাজিপাড়া এলাকায় দু’টি সিঁড়ির কাজ। এই দু’টি হলেই উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হবে। এছাড়া মেট্রোরেল সম্পর্কে যাত্রীদের আগে থেকেই ধারণা দিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
এদিকে, ঢাকা ম্যাস ট্রানসিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের সার্বিক অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। মেট্রোরেলের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ না হতেই এই পথে শুরু করা হয়েছে সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ এখনও পর্যন্ত চলমান রয়েছে। পল্লবী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এ কাজ অব্যাহত আছে। ডিসেম্বরের আগেই এ পথের ডিভাইডারে কয়েক হাজার গাছ লাগানো হবে। মেট্রোরেলের এই পথের বিভাজন রঙিন হবে ফুলে ফুলে।
এ বিষয়ে ডিএমটিসিএলএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক সাংবাদিকদের জানান, উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের জুন পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। সামান্য কিছু কাজ এখন বাকি রয়েছে। আশা করি সে কাজ দ্রুতই শেষ করা হবে।
এদিকে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি মহল দৈনিক দেশ বাংলাকে জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরে দেশের প্রথম স্বপ্নের মেট্রোরেল উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এরই মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের ১৪টি মেট্রো ট্রেন সেট ইতোমধ্যে উত্তরাস্থ তুরাগের ডিপোতে পৌঁছেছে। মেট্রো ট্রেনগুলির নিরাপদ সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উত্তরা ডিপোতে Stabling Yard ও Workshop নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ার্কসপে Mobile Synchronized Lifting Jacks স্থাপন করা হয়েছে। Overhead Catenary System (OCS) বিহীন রেলওয়ে ট্র্যাকে মেট্রো ট্রেন Shunting করার জন্য Electric Tractor সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হচ্ছে। উদ্ধার কাজের জন্য Rail cum Road Vehicle for Re-Railing of Rail Vehicles সংগ্রহ করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ডিসেম্বরে মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্যেই দ্রুত কাজ এগিয়ে চলছে। মিরপুর ১০ আর কাজিপাড়া এলাকায় মেট্রোর দু’টি সিঁড়ির কাজ শেষ হলেই অবকাঠামো নির্মাণের শতভাগ শেষ হচ্ছে। উদ্বোধনের আগে পল্লবী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত গাছ লাগানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মহলের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান, এছাড়া মেট্রোরেল সম্পর্কে জনসাধারণকে সম্যক ধারণা দিতে এমআরটি লাইন-৬ এর উত্তরা ডিপো এলাকায় মেট্রোরেল এক্সিবিশন এবং তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। মেট্রো ট্রেনের Mock Up উত্তরা ডিপোস্থ MREIC-তে স্থাপন করা হয়েছে। মূল মেট্রো ট্রেন সেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনসাধারণকে মেট্রো ট্রেনের যাতায়াত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচলে সক্ষম ২ সেট ছোট আকারের মেট্রো ট্রেন সংগ্রহ করে MREIC-তে স্থাপন করা হয়েছে। মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে মিল রেখে Ticket Office Machine (TOM) এবং Ticket Vending Machine (TVM) উত্তরাস্থ MREIC-তে স্থাপন করা হয়েছে। মেট্রো স্টেশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে Smart Card Based স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ এবং বহিরগমন গেইটও স্থাপন করা হয়েছে। MRT Pass বা Rapid Pass ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় প্রবেশ এবং বহিরগমন গেইট দিয়ে MREIC-তে প্রবেশ করতে হবে। MREIC-এর প্রদর্শনী হলে প্রদর্শনের জন্য মেট্রোরেলের অভ্যন্তরে ও মেট্রোরেল স্টেশনে যাত্রীদের করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়সমূহের সচিত্র উপস্থাপনা সম্বলিত ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। MREIC-এর ভিডিও প্রদর্শনী হলে প্রদর্শনের জন্য ভিডিও এবং এ্যানিমেটেড কার্টুন নির্মাণ করা হয়েছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানসিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল এবং প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে স্বপ্নের মেট্রোরেলের প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য বিদেশ থেকে ৯ ধরনের বিশেষায়িত যন্ত্র আমদানি করা হচ্ছে। এ ধরনের যন্ত্রপাতি এর আগে বাংলাদেশে আমদানি হয়নি। ফলে এসব যন্ত্রপাতি আমদানির এইচএস কোডও নেই। এ অবস্থায় মেট্রোরেলের এই নতুন ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে নতুন এইচএস কোড নির্ধারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে আবেদন করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এনবিআর এখন এইচএস কোড নির্ধারণের কাজ করছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, প্ল্যাটফর্মের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে এর মধ্যে রয়েছে- টিকিট অফিস মেশিন বা টম, টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, কার্ড ইনিশিয়ালাইজিং ডিভাইস, ওয়েসাইড রেডিও সেট, স্বয়ংক্রিয় গেট বা প্যাসেঞ্জার গেট, এডিও এক্সিট এন্ট্রান্স ডোর ফর ড্রাইভার, প্ল্যাটফর্ম অ্যান্ড ডোর (পিইডি), প্ল্যাটফর্ম স্কিন ডোর ও বেলাইজ এনকোডার। এনবিআর এসব পণ্যের জন্য এইচএস কোড নির্ধারণ করে দেওয়ার পর ডিএমটিসিএল আমদানির এলসি খুলবে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরার মেট্রোরেলের সার্বিক উন্নয়নমুলক কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচেছ। এরমধ্যে ২০ কিলোমিটারের মেট্রোরেল বা এমআরটি-৬ রুটের মোট কাজের প্রায় ৮৫ ভাগ শেষ হয়েছে। আর প্রথম পর্যায়ে চালুর জন্য নির্ধারিত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশের কাজ ৯১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী বছরের মার্চের মধ্যে দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে মেট্রোরেল চালু করার লক্ষ্য নিয়েই কাজ হচ্ছে। ট্রেনগুলোর ট্রায়াল ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হতে এই সময় লাগবে। স্টেশনে ওঠানামার সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি বা এস্কেলেটর এবং লিফট বসানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি।
সূত্র জানান, ৯টি স্টেশনগুলোর কাজ খুব বেশি বাকি নেই। হেঁটে ওঠার সিঁড়ির কাজ শুরু হচ্ছে। এর পরেই লিফট বসানোর কাজও শুরু হবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেলপথে ৯টি স্টেশন নির্মাণ হবে। সব স্টেশনের ছাদ, প্ল্যাটফর্মের ছাদ এবং স্টিল অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। তিনটি আইকনিক স্টেশনসহ সব স্টেশনের রুফশিট স্থাপন শেষ। উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশনের বিদ্যুতের কাজ, প্লাম্পিং, স্থাপত্যকাজ চলমান। এ ছাড়া স্টেশনগুলোয় প্রবেশ ও বহির্গমন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী স্টেশনের প্রবেশ ও বহির্গমন অবকাঠামো নির্মাণ চলছে। মোট ২৪ সেট ট্রেনের মধ্যে ১২ সেট ট্রেন দেশে এসেছে। প্রথম দফায় ৯টি স্টেশনে মেট্রোরেল চালু হবে ১০ সেট ট্রেন দিয়ে। বহু প্রতীক্ষিত মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬-এর উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের হলঘরের ছাদ, প্ল্যাটফর্মের ছাদ, ইস্পাতের ছাদ ও আইকনিক স্টেশনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি মেট্রোরেল হিসেবে অধিক পরিচিত।
নির্মাণপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা দৈনিক দেশ বাংলাকে জানান, কনকার্স রুফ, প্ল্যাটফর্ম রুফ, স্টিল রুফ স্ট্রাকচার, আইকনিক স্টেশন স্থাপনসহ সব স্টেশনের জন্য কনকার্স রুফ ও রুফ স্টিলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই সার্ভিস ট্রান্সফার, চেক বোরিং, টেস্ট পাইল, মেইন পাইল, পাইল ক্যাপ, আই-গ্রিডার, প্রিকাস্ট সেগমেন্ট কাস্টিং ও সব স্টেশনের জন্য সাব-স্ট্রাকচার নির্মাণ সম্পন্ন করেছি।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, একটি স্বপ্নের গণপরিবহন মেট্রোরেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ গতিতে নির্মাণকাজ অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হবো।
তিনি আরও জানান, এই পরিবহন ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। এ ছাড়া এতে প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা সময় কমিয়ে মাত্র ৪০ মিনিটেই উত্তরা থেকে মতিঝিলে যাওয়া যাবে। এমআরটি লাইন সম্পন্ন হয়ে গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এই মেট্রোরেল নির্মাণ করছে। তারা এ প্রকল্পে সহজ শর্তে ঋণ দিয়েছে।
এদিকে, আজ রোববার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তুরাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মেহেদী হাসান দৈনিক দেশ বাংলাকে জানান, উত্তরা- তুরাগের ডিয়াবাড়িতে মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ যে কোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড রোধ কল্পে তুরাগ থানা পুলিশ নিরলস ভাবে কাজ করে যাচেছন।
ওসি জানান, আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্হিতি অনেক উন্নত হয়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রনে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
রাতের বেলায় মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকায় পুলিশের কঠোরনজরধারী বাড়ানোসহ পুলিশি টহল আগের চেয়ে বৃদ্বি করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
মেট্রোরেল প্রকল্প সূএে জানা যায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।