
লাইক, কমেন্ট, শেয়ার রোগে আক্রান্ত গণমাধ্যম
- কেউ জনপ্রিয় হলেই টার্গেটে পড়েন
- দেশদরদী, সমাজসেবীর রক্ষা নেই
- সাংবাদিকতা মানেই যেন কুটনামি
এখন চলছে ধ্বংসযজ্ঞের সাংবাদিকতা! টিকটক মার্কার ফালতুমি কর্মকান্ড আর গ্রাম্য চাতাল নারীদের মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কুটনামি করাটাই এখন সাংবাদিকতার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে! সারাদেশের কৃষক সমাজ সার, কীটনাশকের অভাবে যখন কপাল চাপড়িয়ে কাঁদেন, আমরা তখন পরীমনির মাদক কান্ডকে লিড স্টোরি হিসেবে প্রকাশ করে বিকৃত আনন্দে মেতে উঠি!
রিপোর্টিং বিভাগ, নিউজ ডেস্ক, তারও উপরে থাকা নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিরাও এখন টিকটকারদের মতো শুধু লাইক, কমেন্ট, শেয়ার খুঁজেন! দেশ, দেশের মানুষ কিংবা ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী এখন কী গণমাধ্যমের কাছে কাঙ্খিত সাড়া পাচ্ছেন? নাকি সমাজ ও মানুষের জন্য কোনরকম ম্যাসেজ না দিয়েও শুধু বিকৃত অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে, গণ্ডমূর্খতা ছড়িয়ে হিরো আলম, প্রবাস ফেরত মানিক মিয়া, পরীমনি কিংবা ঘৃণ্য অশ্লীলতা ছড়িয়ে বেড়ানো একশ্রেণীর টিকটকাররাই মিডিয়ার কাছে অতিমাত্রায় গুরুত্ব পাচ্ছে?
বাইরের দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুপরিচিত হয়ে ওঠা ব্যক্তিরা মাত্র দুই, তিন মিনিটের উচ্চ মানসম্পন্ন ক্ষুদে ভিডিও পাবলিকলী পোস্ট করে থাকেন। তাদের প্রতিটি ক্ষুদে ভিডিওতেই যেমন হাসি আনন্দ থাকে, তেমনই সমাজ ও জীবনের জন্য কোনো না কোনো বার্তা থাকে। সচেতনতা সৃষ্টির চমৎকার উদ্যোগও সেসব ভিডিওতে লক্ষ্যনীয়। কিন্তু তার বিপরীতে এদেশের টিকটকের চলমান নর্দমার জোয়ারে কী দেখছি আমরা? বস্তা পঁচা অতি নিম্নমানের অশ্লীলতার ক্ষুদে ভিডিওতে লাইক, শেয়ারেরও অভাব নেই। কারা লাইক দেন, কারা শেয়ার করেন? তাদের প্রোফাইলে একবারের জন্য ক্লিক করলেই তা সহজে অনুমেয়।
অনেক ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে মসজিদে জুমা’র নামাজ আদায় করতে গিয়ে ‘ভালো মন্দ’র ব্যবধান নিয়ে হুজুরের একটি বয়ান শুনেছিলাম। তিনি বলছিলেন, অনেক পাক পবিত্রতার সঙ্গে পোলাও, মাংস রান্না করে তা যত্নের সঙ্গে ঢেকে রাখা হলে সেখানে মশা, মাছি, কীট পতঙ্গের ওড়াওড়ি দেখা যায় না বললেই চলে। কিন্তু খোলা জায়গায়, নোংরা পরিবেশে কয়েকদিনের পঁচা, গলা, উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত কুকুর, বিড়ালের মরদেহ ফেলে রাখলে সেখানে হাজারো কীটপতঙ্গ, বন্যপ্রাণী, মাছি, পাখির রীতিমত ভীড় ভাড়াক্কা হতে সময় লাগে না। হুজুরের দেয়া এ বয়ানের মর্মার্থ বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল আমার। তারপরও পূর্ণাঙ্গ হৃদয়াঙ্গমে যেটুকু ব্যর্থতা ছিল তা টিকটকের লাইক, শেয়ারের জোয়ার থেকে শিখতে সক্ষম হয়েছি।
কষ্ট, যন্ত্রণার একটি কথা বলতে গিয়ে এতগুলো কথা তুলে মূলত বিরক্তই করে ফেললাম। বলতে চেয়েছিলাম আর. জে কিবরীয়া সংক্রান্ত বিষয়ে। অসম্ভব মেধাবী, বিনয়ী, প্রাণচ্ছ্বোল মানুষটির পুরো নাম মোঃ গোলাম কিবরীয়া সরকার। রেডিও শ্রোতাদের কাছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয় রেডিও জকি তিনি। তার ক্ষেত্রে আমি ‘জকি’ শব্দের পরিবর্তে ‘রেডিও ব্যক্তিত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী। রেডিও’র আনন্দঘন নানা অনুষ্ঠানমালার ফাঁকে ফাঁকে কত শত সামাজিক দায়িত্ব যে পালন করা যায়, রাষ্ট্রীয় ও মানবিক কর্তব্য সম্পাদন করা যায় তার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হচ্ছেন আর.জে কিবরীয়া নিজেই।
লাখ লাখ রেডিও শ্রোতার অতি আপনজন আর.জে কিবরীয়া স্বপরিবারে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে পারিবারিক বিবাদের শিকার হন। তুচ্ছ বিবাদ হলেও বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আর এই জিডিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর গণমাধ্যম কর্মিদের বিরাট কাফেলা রীতিমত হামলে পড়ে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বঘোষিত লাইভ ভিডিও প্রচারকারী অখাদ্য টিকটকার চক্র। এগিয়ে যায় ‘ওয়ান ম্যান শো’ হিসেবে চিহ্নিত কথিত অনলাইন মিডিয়ার বিশাল বপুরাও। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মতো কল্প, কাহিনী, রহস্যময়তার নানা মুখরোচক ‘ভয়ঙ্কর সংবাদ’ ছড়িয়ে দেয়া হলো নেট দুনিয়ায়। যেন সেলিব্রেটিকে কেন্দ্র করে ‘ভাইরাল’ হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লো কয়েকশ’ ঘৃণ্য দানব।
দুর্নাম চর্চা, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস মোটেও সাংবাদিকতা নয়
দুর্নাম চর্চা, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, অপপ্রচার মোটেও সাংবাদিকতা নয়, বড়জোর অপসাংবাদিকতা। যা ফেসবুকের পাতায় পাতায় অহরহ দেখতে পাওয়া যায়। নিজের আইডিতে স্ট্যাটাস দেয়ার নামে, গ্রুপে কিংবা পেইজে নিউজের আদলে এগুলো বেশি প্রকাশ করা হয়। আবার কেউ কেউ আগাম হুমকি দেয়ার স্টাইলেও অপসাংবাদিকতার বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা আরো সুন্দরভাবে হয়তো বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারবেন, তবে আমি মনে করি: যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও কর্মকান্ড ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকা উচিত যতক্ষণ তা দ্বারা অন্য কেউ ক্ষয়ক্ষতির শিকার না হন। ধরুন এক দম্পত্তি প্রতি রাতে তাদের দরজা জানালা বন্ধ করে সারারাত মদ পান করেন, ড্যান্স দেন, গান বাজনায় মত্ত থাকেন। এমন কাজ যদি অন্য কারোর জন্য ডিস্টার্বের কারণ না হয় তাহলে সে বিষয়ে কারো হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। আইনগত ভাবে এ অধিকার নেই। অথচ আপনি সাংবাদিক হিসেবে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করলেন, ড্রোন বা স্পাইক্যাম ব্যবহার করে তার ঘরের দৃশ্যাবলী ভিডিও করলেন, সে কোথা থেকে মদ কিনে আনে তার রিসিট জোগাড় করলেন, সেসব প্রচারের উদ্যোগ নিলেন; এসবই আপনার অনৈতিকতা এবং অপরের প্রাইভেসী ভঙ্গের শামিল।
মনে রাখা উচিত, কুটরামি, বদনামী চর্চা কখনোই সাংবাদিকতা নয়। যে খবর সমাজ, রাষ্ট্র, জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো প্রভাব ফেলে না তা কখনই সংবাদ হতে পারে না, সেসব নিয়ে সংবাদ প্রস্তুত বা প্রচার প্রকাশ করাটাও সাংবাদিকতা হতে পারে না।…সাঈদুর রহমান রিমন
#
(কাল পাঠ করুন নারীতেই নাকি নিউজ খায়?)