
আকতারুজ্জামান, মেহেরপুর থেকেঃ
ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং তার সত্যতার স্মারক। ‘মৌন অতীতকে সে মানুষের কাছে ব্যক্ত করে নির্মোহ-নিরপেক্ষতায়। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সীমান্ত-শহর মেহেরপুরের গাংনীর কাজলা নদীর কোল ঘেঁষে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ভাটপাড়া নীলকুঠি। সেই সাথে কালের স্মৃতি হয়ে যেখানে সেখানে আগাছার মতো বেড়ে উঠছে নীল গাছ। এটি সংরক্ষণ করলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে নীল চাষের ইতিহাস সেই সাথে দেখতে পারবে চাষিদের বুকের পুঞ্জিভুত রক্তের বদলে নীল রং তৈরীর সেই নীল গাছ।
‘নীলচাষ’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো ইংরেজ সাহেবের হাতে চাবুক, অসহায় কৃষকের চোখে জল, আহাজারি ও ক্ষুধার হিংস্র থাবা। কলঙ্কিত আগ্রাসন ও ক্লেশময় সামাজিক সংগ্রামের চিহ্ন হয়ে আছে নীলচাষের ইতিহাস। তেমনি এখনও মেহেরপুরের গাংনীর ভাটপাড়ায় সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলকুঠি। ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম নামে এক ইংরেজ ব্যক্তি ভাটপাড়া কাজলা নদীর তীরে ২৩ একর জমির ওপর নীলকুঠি স্থাপন করেন। তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল ব্যবসায়ীদের দোর্দান্ত প্রতাপে দিশেহারা ছিল নীল চাষীরা। নির্যাতিত নীল চাষিদের দুর্বার আন্দোলনের মুখে বাংলার বুক থেকে নীল চাষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও নীলকরদের অত্যাচার নির্যাতন ও শোষনের স্মৃতি নিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ভাটপাড়া নীলকুঠি। কালের বিবর্তনে অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হতে চলেছে নীলকুঠি। দামি মার্বেল পাথর আর গুপ্তধনের আশায় ভেঙে ফেলা হয়েছে মুল ভবনসহ সব কিছু। তবে আগাছার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে জন্ম নিয়েছে নীল গাছ।নীলগাছ দেখতে অনেকটাই গাঁজা গাছের মতো। সে সময় এক বিঘা জমিতে নীল তৈরী হতো ২-৩ সের। সেই নীল বিক্রি হতো ১৩-১৪ টাকায়। কিন্তুু নিল চাষীরা উৎপাদন খরচ হিসাবে পেত মাত্র ৩ টাকা। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে খুন করে লাশ গুম করা হতো। এমনকি চাষিদেরকে দাঁড় করিয়ে মাথার উপরে মাটিতে নীলের বীজ বপন করে অনাহারে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। ঐ বীজ থেকে চারা না গজানো পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দেয়া হতো না।
দর্শনার্থী মকলেচুর রহমান জানান, তারা বই পুস্তকে নীল চাষ সম্পর্কে পড়েছেন। পড়েছেন নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী। আর দেখতে পারছে দু’শ বছর আগে ইংরেজদের নির্মিত নীলকুঠি যা কালের স্বাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাথে দেখতে পারছেন নীল গাছ ।
স্কুল ছাত্রী নুসরাত জামান জানায়, নীলগাছ কখনোই দেখিনি। বইতে পড়েছি। বাবার কাছে আবদার করে নীলগাছ দেখলাম। নীলগাছ সম্পর্কে অনেক ধারনা তৈরী হল।
কলেজছাত্রী ফাতেমা জানায়, ইতিহাস বই পড়ে কিছুটা ধারনা হয়েছিল। পরিবারের সাথে নীলকুঠিতে এসেছি। জরাজীর্ণ অবস্থায় নীলকুঠি দাঁড়িয়ে আছে, আশপাশে নীল গাছও রয়েছে। তার বাস্তবতা আমাদের মত নতুন প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গাংনী মহিলা ডিগ্রী কলেছের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক দিলরুবা সুলতানা বলেন,
অনেক কিছুই কালের পরিবর্তনে বিলুপ্তির মুখে। এক সময়কার বাস্তবতা এখনকার ইউতিহাস। নীলকরদের করুন ইতিহাস মনে করলে শরীরের লোম দাাঁড়িয়ে যায়। নির্যাতনের স্মৃতি চিহ্ন ভাটপাড়া নীলকুঠিকে নতুন প্রজন্মের কাছে ধরে রাখতে সংস্কার ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম জানান, ইতোমধ্যেই নীলকুঠিটি সংস্কার ও নীলগাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মরা ইংরেজ শাসনামলের বিষয়ে জানতে পারে ও নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে অবহিত হতে পারে।
মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন দৈনিক দেশবাংলাকে বলেন, আমার নির্বাচনী এলকার একমাত্র ইতিহাস যুক্ত স্থান ভাটপাড়া নীলকুঠিবাড়িকে নতুন প্রজন্মের জন্য ধরে রাখতে সরকারি ভাবে সংস্কার ও সংরক্ষনের সরকারের কাছে সর্বাত্নক দাবী জানাবো। বাংলার মানুষ নীলকরদের কাছে যে ভাবে নির্যাতিত হয়েছিল তাদের সেই মাথা উচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য যা যা করা প্রয়োজন আমি করবো।