
বিশেষ প্রতিবেদকঃ
ঈদ পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার যেন মহামারী শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই দুঘঠনার কোটা ডজনের ঘর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতে অনেকেই হতাহত হচ্ছেন, ক্ষয়ক্ষতি বেশুমার।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না কোনভাবেই। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা ঘটছে, ঝরে যাচ্ছে একের পর এক প্রাণ। যারা বাঁচে তাদের অনেককেই সারা জীবন পঙ্গু হয়ে থাকতে হয়। গতকাল শনিবার একদিনের সড়ক দুর্ঘটনাতেই বগুড়ায় চার জন, টাঙ্গাইলে আট জন, ময়মনসিংহে তিন জন, অন্যান্য জেলার সড়ক মহাসড়কে সংঘটিত মোট ১১টি দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭ জনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে, আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক যাত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালে মহাসড়ক পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাইভেটকার ও অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২, আহত ৪। তাড়াশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩, আহত ১০। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় লোকমান মণ্ডল (৭০) নামের এক কৃষক মারা গেছেন। বগুড়ার শেরপুরে যাত্রীবাহী দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত স্বামী-স্ত্রী মারা গেছেন। বাঁশির সুরে অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখা কুমিল্লার বাঁশিবাদক মনির হোসেন বাসচাপায় নিহত হয়েছেন। রাজধানীর বাংলামোটরে পান্থকুঞ্জ পার্কের পাশে বাসের ধাক্কায় ইব্রাহিম বিশ্বাস (২৪) নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। বগুড়ার কাহালুতে প্রাইভেটকার ও মিনি ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বাবা-ছেলেসহ ৪ জন নিহত হয়েছেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা বালুবাহী ট্রাকের পেছনে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় ৪ জন নিহত হয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করেই সড়কে কেন এত দুর্ঘটনা?
এ প্রশ্নে পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক, চালক, সহকারীরা দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তারা জানিয়েছেন, মাত্রাতিরিক্ত গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালানোকালে চালকরা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বেশিরভাগ চালকই উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে ভুগেন। চরম অসুস্থ অবস্থায়ও সড়ক মহাসড়কে প্রতিয়োগিতামূলক ভাবে গাড়ি চালাতে গিয়েই একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন তারা। তাছাড়া ঈদ পরবর্তী সময়ে সর্বত্র বন্ধু স্বজনদের আমন্ত্রণে গরুর মাংসসহ খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না অনেকের। ফলে দ্রুতই তারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে আরো বিপাকে পড়ছেন। চালকদের শারিরিক অসুস্থতাই দুর্ঘটনার অন্যতম নিয়ামক হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে অভিন্ন মতামত দিয়েছেন চিকিৎসকরাও।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালনার কারণে দেশের মহাসড়কগুলো যেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশে আইন আছে, রয়েছে শাস্তির বিধান। কিন্তু আইনের নানা ফাঁকফোকর আর পুলিশের মামলা জটিলতায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের তেমন ‘কিছুই হয় না’।
ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পদে পদে চলে ট্রাফিক আইন অমান্যের প্রতিযোগিতা। আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে মোটরযান আইনের যথাযথ ধারায় ব্যবস্থা না নেওয়া, মাসোয়ারা পদ্ধতিতে ‘চলাচল অযোগ্য’ হাজার হাজার গাড়িকে অবাধে চলাচলের সুযোগ করে দেওয়া; সর্বোপরি চালকদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব গড়ে ওঠার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোর চেয়ে এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা গড়ে ২৮ গুণ বেশি। প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার মানুষ এ দেশে প্রাণ হারায় সড়ক দুর্ঘটনায়, আহত হয় অন্তত ৫০ হাজার। আহতের অনেকেই পঙ্গুত্বের ভার বয়ে বেড়ায় মৃত্যু পর্যন্ত। এত জানমালের ক্ষতিসাধনকারী দুর্ঘটনার কোনোটিতেই ঘাতক গাড়িচালক ও মালিকদের আইন-আদালতে শাস্তি পেতে হয়নি।