নিজস্ব প্রতিবেদক: ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতকেন্দ্রিক বেচাকেনা জমে উঠেছে। তবেলাগামহীন চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসার লাভের টাকা ঘরে তুলতে পারছেন না ফুটপাতের হকাররা। হকার্সসমিতির নেতারা বলছেন, গত দুই বছর করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা হয়নি। এতে স্বল্প পুঁজির এইব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকে পুঁজি হারিয়ে ফেলেছেন, অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়েপড়েছেন। তবে এই বছর ঈদ মৌসুমে ব্যবসায় প্রাণ ফিরলেও অতিরিক্ত চাঁদাবাজির কারণে তাদেরআনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। গত ৩ দিনে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর, ১১ নম্বর, ভাসানটেক, মিরপুর ১, কাওরানবাজার, গুলিস্তান, মতিঝিল, নিউ মার্কেট, মহাখালী এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, ‘ঈদ বকশিসে’র নামে মোটাঅঙ্কের চাঁদা দিতে হচ্ছে ফুটপাতের হকারদের। তাদের অভিযোগ, ‘ফুটপাতে বেচাকেনার জন্য সারাবছরইএকটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হলেও এই ঈদের আগে চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ, তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েগেছে।’ অভিযোগ রয়েছে, কতিপয় পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতার আশীর্বাদেফুটপাতের দখল এখন লাইনম্যানদের হাতে। ঈদের আগে প্রতিদিনই কোটি টাকার চাঁদা তুলছেনলাইনম্যানের অধীনে থাকা পেশাদার চাঁদাবাজরা। মিরপুর শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ফুটপাতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাক বিক্রেতাবলেন, ‘প্রতি মাসে আমি ৪ হাজার টাকা চাঁদা দেই। কিন্তু গত পরশুদিন লাইনম্যান বলে গেছেনরমজানের শেষ ৪ দিনের জন্যই ৪ হাজার টাকা দিতে হবে। চাঁদা না দিলে অন্য ব্যবসায়ীকে এই জায়গায়বসিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়ে গেছেন।’ হকারদের অভিযোগ, লাইনম্যানরা তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নিয়ে যান। চাঁদার সবচেয়ে বড় অংশপুলিশ সদস্যদের এবং বাকি অংশ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ভাগ করে দেন। মিরপুরেরবেশিরভাগ ফুটপাতসহ মূল সড়কের এক-তৃতীয়াংশই রয়েছে চিহ্নিত চাঁদাবাজদের দখলে। ফুটপাতদখল করে অবৈধ স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার বসিয়ে বিভিন্ন অঙ্কে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকাহাতিয়ে নিচ্ছে এই চিহ্নিত চাঁদাবাজচক্র। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মুক্তবাংলা শপিং সেন্টারের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, শাহ আলী মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেটের সামনে ফুটপাতসহ মূল সড়ক দখল করে বসে শত শত দোকান। ফলে এখানদিয়ে পায়ে হেঁটে চলাই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। যানজট তো নিত্যনৈমিত্যিক চিরচেনা রূপেই লেগে থাকে। মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চিড়িয়াখানা রোডের সনি সিনেমা হল থেকে শুরু করেঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত ফুটপাত ও সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাজার। বাজারে কয়েক-শ দোকানবসিয়ে চলছে নিয়মিত চাঁদাবাজির মহোৎসব। থানা পুলিশ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নামভাঙিয়ে প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে দোকানদারেরাঅভিযোগ করেছেন। এছাড়াও মিরপুর ১০ থেকে শুরু করে পল্লবী, ভাষানটেক, রূপনগরের বিভিন্নএলাকায় ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে। ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে বসা ভ্রাম্যমাণব্যবসায়ীদের (হকার) কাছ থেকে মাসে প্রায় ৩২ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। বছর হিসাবে এটিরপরিমাণ প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। চাঁদার এ টাকার ভাগ পাচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ওঅঙ্গসংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ফুটপাতের একাধিক ব্যবসায়ী ও চাঁদা আদাকারীদের (লাইনম্যান) সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানাগেছে। তাঁরা বলছেন, ব্যবসার ধরনভেদে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরসংলগ্ন প্রায় ৭৩০টি দোকান থেকেদৈনিক ৮০ থেকে ১৫০ টাকা নেওয়া হয়। কিছু দোকানের মালিককে দিতে হয় ২৫০ টাকা। অন্যদিকেমিরপুর-১০ নম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে ‘স্ট্রিট ভেন্ডর’ কার্যক্রম চালু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।ফুটপাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে চালু করা এ কর্মসূচি এখন হকারদের জন্য ‘হিতে বিপরীত’ হয়েদাঁড়িয়েছে। চাঁদার পাশাপাশি এখন ‘হকার অ্যাপের’ নামে দিতে হচ্ছে বাড়তি আরও ২০ টাকা। একজন হকার বলেন, পেটের দায়ে ব্যবসা করি। দোকান করতে হলে টাকা দিতেই হবে। নইলে ব্যবসাবন্ধ। সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে কাজীপাড়া, মিরপুর-২, মিরপুর ১২ কিংবামিরপুর ১৪ নম্বর সব দিকের ফুটপাতেই দোকান রয়েছে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের। দোকানের কারণে ফুটপাতদিয়ে হেঁটে চলার জো নেই। কোথাও পুরো ফুটপাতই দখল হয়ে গেছে। পথচারীরা চলছেন মূল সড়কেনেমে। চাঁদাবাজি ৪০ লাখ টাকা ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও লাইনম্যানরা বলছেন, মিরপুর-১০ নম্বরে যেতে বেগম রোকেয়া সরণির সেনপাড়াঅংশ থেকে চৌরঙ্গী মার্কেট পর্যন্ত ফুটপাতে প্রায় ২৩টি দোকান থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়াহয়। চৌরঙ্গী মার্কেট থেকে বড়বাগের দিকে যাওয়ার রাস্তা (বাউন্ডারি সড়ক) ও ফুটপাতে রয়েছে প্রায় ৫৩টিদোকান। সেখানে ডাব, ফল, সেদ্ধ ডিম ও ভ্যানগাড়ির প্রায় সাতটি দোকান থেকে ৮০ টাকা এবংভাজাপোড়া, ফাস্ট ফুড, চা-সিগারেট ও জুস বিক্রির প্রায় ৪৬টি দোকান থেকে ১৩০ টাকা করে চাঁদানেওয়া হয়। ওই অংশে মাসে প্রায় ৩ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হয়। চৌরঙ্গী মার্কেটের পরে দেওয়ান ও আনোয়ার ম্যানশন হয়ে পদচারী–সেতুর সিঁড়ির নিচে পর্যন্ত ছোট–বড়প্রায় ৪৮টি দোকান আছে, যা ফলপট্টি হিসেবে পরিচিত। এর পরে পদচারী–সেতুর সিঁড়ির নিচে হাতঘড়ি, বেল্ট, সিগারেট, ফুল ও খবরের কাগজ বিক্রির ২৬টির মতো দোকানে রয়েছে। ওই অংশে দৈনিক ২৫০টাকা হিসাবে মাসে ৫ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। মিরপুর-২ নম্বরের দিকে যেতে (দক্ষিণ পাশে) সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সামনে থেকে সুলতানস ডাইনপর্যন্ত রয়েছে শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, পাঞ্জাবিসহ নানা পোশাক বিক্রির প্রায় ১২০টি দোকান। এসব দোকানথেকে দিনে ২০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এ হিসাবে মাসে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়।মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সামনে বসে ১২৭টির মতো দোকান। মিরপুর-১৪নম্বরের দিকে গার্লস আইডিয়াল স্কুলের সামনে পর্যন্ত উত্তর পাশের ফুটপাতে প্রায় ১৬০টি দোকান ওদক্ষিণ পাশে (শাহ্ আলী মার্কেট থেকে আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়) অংশে রয়েছে আরও প্রায় ৯৫টি দোকান।ওই তিন জায়গার পৌনে চার শর বেশি দোকান থেকে দৈনিক ১৩০ টাকা করে ৫০ হাজার ও মাসে ১৪ লাখ৪৮ হাজার টাকা চাঁদা তোলা হয়। তিন নেতা চাঁদাবাজির ‘মূল হোতা’ হকার ও লাইনম্যানদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চাঁদাবাজি চক্রের মূলে রয়েছেন আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গও সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন নেতা। তাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন ৯৪ নম্বরওয়ার্ড যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও মহানগর উত্তর আওয়ামী হকার্স লীগের সহসভাপতি জাফরগাজী। লাইনম্যানরা তাঁর কাছেই চাঁদার টাকা জমা দেন। বাকি দুজন হচ্ছেন ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম ওরফে ফুট আখের ও একই ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক লীগেরসাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ হানিফ ওরফে ফালান। সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং দিয়েব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়া এবং ভয় দেখিয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য করাই তাঁদের কাজ। এ তিনজনের সঙ্গে যুক্তআছেন মিজানুর রহমান (মিজান) নামের আরেক ব্যক্তি। হকারদের কাছে তিনি মিরপুর মডেল থানারভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সহকারী ও পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। চাঁদার টাকায় পুলিশ যে ভাগপায়, তা মিজানের কাছে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ফুটপাতের ব্যবসায়ী ও লাইনম্যানেরা। লাইনম্যান যারা বাউন্ডারি সড়কে চাঁদা তোলেন মো. হাসান। তিনি জাফর গাজীর আপন ভাতিজা। চৌরঙ্গী মার্কেটেরসামনে তাঁর একটি ফল বিক্রির দোকান আছে। ফলপট্টি অংশে চাঁদা তোলেন হেলাল ও মনির নামেরদুজন। পদচারী–সেতুর নিচে হেলালের খবরের কাগজ বিক্রির দোকান। ফলপট্টিতে দোকান আছেমনিরের। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে সুলতানস ডাইনের সামনের ফুটপাতে ব্যবসায়ীদের কয়েকজনপ্রতিনিধি চাঁদা তোলেন। একসঙ্গে ১০-১৫টি দোকান থেকে চাঁদা তোলেন ফুটপাতেরই একজন হকার।তাঁদের কয়েকজন হচ্ছেন প্যান্ট বিক্রেতা পান্ডা আলমগীর, শার্ট বিক্রেতা জুয়েল (মিজানের শ্যালক) ওআরেক শার্ট বিক্রেতা সাঈদ। তাঁরা চাঁদার টাকা একত্র করে জাফরের বড় ভাই মুসার কাছে দেন।পদচারী–সেতুর নিচে মুসার ফুল বিক্রির দোকান আছে। কার পকেটে কত হকাররা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতা, ওয়ার্ড কাউন্সিলর, থানা ও ট্রাফিক পুলিশকে ম্যানেজ করতেচাঁদা দেওয়া লাগে। তবে কে কত পায়, সেটা তাঁদের জানা নেই। একজন হকার বলেন, ‘পেটের দায়ে ব্যবসাকরি। দোকান করতে হলে টাকা দিতেই হবে। নইলে ব্যবসা বন্ধ।’ চাঁদার ভাগ কে কত টাকা পায়, তা শুধুজাফর, আখের ও ফালান—এ তিনজন জানেন বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে জানতে আগে লাইনম্যানছিলেন এমন একজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, মিরপুর–১০ গোলচত্বর কেন্দ্রিক পাঁচটি ফুটপাতের অংশে চাঁদাবাজি চলে। সেখান থেকে ১৪ নম্বরওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদকে আগে মাসে ১ লাখ টাকা দেওয়া হতো। ওই টাকা মুরসালিন নামেরএকজন লাইনম্যান খামে ভরে কাউন্সিলর কার্যালয়ে দিয়ে আসতেন। এখন প্রতি মাসে কম করে হলেওদেড় লাখ টাকা দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি আরও বলেন, পুলিশের টাকা নিতেন মিজানুর রহমান। প্রতি মাসে ১লাখ টাকা মিরপুর থানার সামনে গিয়ে মিজানের কাছে দিয়ে আসা লাগত। অন্যান্য লাইনম্যানের কাছথেকে আরও প্রায় আড়াই লাখ টাকা পুলিশের জন্য মিজানের কাছে দেওয়া লাগত। ব্যবসায়ীদের নানানঝামেলায় থানা-পুলিশকে পাশে রাখতেই এই টাকা দেওয়া হতো। এ ছাড়া গোলচত্বরে ট্রাফিক পুলিশবক্সে প্রতি সপ্তাহে ২ হাজার ২০০ টাকা ও দিনে দুই বেলায় থানা-পুলিশের টহল গাড়িতে ৭০০ করে মোট ১হাজার ৪০০ টাকা দেওয়া লাগত। আর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের হাতে রাখতে শফিকুল ইসলামও এম এ হানিফ ফুটপাতের সব অংশ মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা নিতেন। ফুটপাতেনতুন ব্যবসায়ী বসানো কিংবা একজনের জায়গায় অন্য ব্যবসায়ী বসা নিয়ে তৈরি ঝামেলাগুলো থানা-পুলিশ ও স্থানীয় নেতারা সমাধান করতেন। ‘চাঁদাবাজরা’ যা বলছেন